সদ্যোজাতের সুরক্ষা নিয়ে সংশয়

সদ্যোজাতের মৃত্যু হার কমাতেই রাজ্য জুড়ে চালু হয়েছিল ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিউ)। কিন্তু সদ্যোজাতের সুরক্ষার সেই ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গত সপ্তাহেই মারা গিয়েছে দু’টি শিশু। শারীরিক অসুস্থতায় নয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ০১:০৫
Share:

ঘটা করেই উদ্বোধন হয়েছিল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের এসএনসিইউয়ের। হাজির ছিলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। ফাইল চিত্র।

সদ্যোজাতের মৃত্যু হার কমাতেই রাজ্য জুড়ে চালু হয়েছিল ‘সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট’ (এসএনসিউ)। কিন্তু সদ্যোজাতের সুরক্ষার সেই ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়ে গত সপ্তাহেই মারা গিয়েছে দু’টি শিশু। শারীরিক অসুস্থতায় নয়। নিতান্তই বিভাগীয় গাফিলতিতে রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারে পুড়ে মৃত্যু হয়েছে ওই দুই সদ্যোজাতের। তাও খাস কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তড়িঘড়ি দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে কর্তব্যরত নার্সদের। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন শাস্তির পক্ষে।

Advertisement

কিন্তু এত কিছুর পর ভয় কাটছে না। বিশেষত যে সব পরিবারে শিশুরা ভর্তি আছে রাজ্যের কোনও না কোনও সরকারি হাসপাতালে। আতঙ্কের সেই ছবি চোখে পড়ল মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। সবংয়ের বাসিন্দা লতারানি মাইতি এখানে এসেই শুনেছেন কলকাতার ঘটনাটি। তাঁর নাতনিকেও ভর্তি করানো হয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যালে। আতঙ্কের ছাপ লুকিয়ে তিনি বলেন, “একটা ওর্য়ামারে একটা শিশুকেই নাকি রাখতে হয়। কিন্তু এখানে তো অনেককে এক সঙ্গে রাখা হয়েছে। সব সময় তো নার্সদিদিরাও থাকছে না। কী করে বুঝব আমার নাতনিটা ঠিক আছে?’’

এটাই প্রকৃত চিত্র। শুধু মেদিনীপুর মেডিক্যাল নয়। ঘাটাল মহকুমা হাসপাতাল এবং ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে এসএনসিইউগুলিও ধুঁকছে পরিকাঠামোগত সমস্যায়। মেডিক্যালেরই এক সূত্রে খবর, এসএনসিইউ-তে ওয়ার্মার রয়েছে ২৮টি। অথচ সেখানে প্রায় ৪০-৪৫টি শিশু ভর্তি থাকে। তাদের দেখাশোনার জন্য নার্স রয়েছেন ২১ জন। প্রায় প্রতিদিনই ছুটিতে থাকেন একের বেশি নার্স। ফলে সমস্যা হয়। মেডিক্যাল অফিসার (এমও) রয়েছেন পাঁচ জন। দিনে তিন জন করে ‘শিফটিং ডিউটি’ করেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্সের কথায়, “পরিকাঠামো দেওয়া হবে না অথচ সামান্য ভুলচুক হলেই দায় এসে পড়বে আমাদের উপর। শিশু মৃত্যু কখনওই অভিপ্রেত নয়। তবে কম সংখ্যক নার্স- কর্মীর পক্ষে বেশি সংখ্যক শিশুর দিকে লাগাতার নজর রাখাও সম্ভব নয়।” তাঁর অভিযোগ প্রায়শই কোনও সিনিয়র ডাক্তার রাতে ডিউটি করেন না। এমনকী সন্ধ্যাতেও তাঁরা আসেন না। জুনিয়র ডাক্তাররাই সব ‘সামলে দেন’। তার উপর মাঝেমধ্যেই অক্সিজেন সরবরাহ কম থাকে। তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়।

Advertisement

জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক সূত্রের অবশ্য দাবি, কলকাতার ঘটনার পর জেলার স্বাস্থ্য-কর্তারাও নড়েচড়ে বসেছেন। এসএনসিইউ-তে যাতে নজরদারির ফাঁক না-থাকে তেমন নির্দেশ এসেছে। নিয়মিত বৈঠক করতেও বলা হয়েছে। তেমন বৈঠক ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে বলে দাবি। গত বুধবার মেদিনীপুর মেডিক্যালে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে এসএনসিইউ-এর সমস্ত দিক নিয়ে আলোচনা হয়। পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েছে কোথায় কোথায়, কী ভাবে তার সমাধান সম্ভব— সে সব নিয়েই মূলত আলোচনা হয়েছে। মেদিনীপুর মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তমালকান্তি ঘোষের অবশ্য দাবি করেছেন, “এসএনসিইউ-তে নজরদারি থাকেই। তবে সেটা যাতে ঠিকঠাক হয়, বৈঠকে তাই-ই বলা হয়েছে।”

কলকাতার ঘটনার পর ঠিক কী নির্দেশ দিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর? দফতরের এক সূত্রে খবর, প্রতি মাসে অন্তত দু’বার বিশেষ পরিদর্শন করতে বলা হয়েছে। পরিদর্শন করবেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের সুপার সহ স্বাস্থ্য-কর্তারাই। এসএনসিইউ-এর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষিত নার্সদের রাখা হয়। মাঝেমধ্যেই তাঁদের অন্য ওয়ার্ডে কাজের দায়িত্বও দেওয়া হয়। আবার কর্মীর অভাবে এসএনসিইউ-তে ডিউটি করেন সাধারণ নার্সরা। এমনটা আর করা যাবে না বলেও নির্দেশে জানানো হয়েছে। এখন থেকে শুধুমাত্র বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সরা এসএনসিইউ-তে ডিউটি করবেন। অন্য ওয়ার্ডে নয়।

এই নির্দেশের বিষয়ে অবশ্য মুখ খুলতে রাজি হননি পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা। তিনি শুধু বলেছেন, “কিছু নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বিভাগীয় ব্যাপারে কিছু বলব না।” পাশাপাশি গিরীশচন্দ্রবাবুর সাফাই, জেলায় এসএনসিইউ-তে কাজের ক্ষেত্রে বড়সড় গাফিলতির অভিযোগ নেই। সামান্য কোনও অভিযোগ এলেও তা গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হয়। পরবর্তী সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও করা হয়।

কিন্তু এসএনসিইউ-তে যে প্রয়োজনীয় সমস্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি তা মেনে নিয়েছেন জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কতা বলছেন, “সব পরিকাঠামো নেই এটা ঠিক। তবে অনেকটাই গড়ে উঠেছে।’’ তাঁর দাবি এসএনসিইউ-তে যে সব নার্স ডিউটি করেন, তাঁদের ৯০ শতাংশই বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বাকি ১০ শতাংশের প্রশিক্ষণও শীঘ্রই হয়ে যাবে। তিনিই জানালেন মেদিনীপুর মেডিক্যালে এসএনসিইউ-এর জন্য রিজিওন্যাল ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে। তবে এটাও স্বীকার করেছেন, একই ওয়ার্মারে একাধিক শিশু থাকে। ওয়ার্মারের সংখ্যা বাড়ানো খুব জরুরি। তবে তাঁর বক্তব্য, “খুব সঙ্কটজনক দু’টি শিশুকে একই ওয়ার্মারে রাখা হয় না। সঙ্কটজনক শিশুকে তো আর ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। তাই যাঁরা একটু সুস্থ্য তাঁদের একসঙ্গে রাখতেই হয়।”

মেদিনীপুর মেডিক্যালের এক কর্তা বলছেন, “আমাদের এখানে এনবিসিসি (নিউ বর্ন কেয়ার কর্নার) রয়েছে। এনবিসিসি-তে একটি ওয়ার্মারও রয়েছে!” গাফিলতি আর নজরদারির ফাঁক গলেই কলকাতা মেডিক্যালে শিশু মৃত্যু হয়েছে। মেদিনীপুর মেডিক্যাল সহ জেলার অন্য হাসপাতালে একই ঘটনা ঘটবে না তো, প্রশ্ন উঠছেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন