আগে দল বাঁচানো! নাকি ভোট-বাহিনীর ধার বাড়ানো? বিধানসভা নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে উভয় সঙ্কটে পড়েছে সিপিএম!
এই সঙ্কটের জেরেই সিপিএমের অন্দরে আপাতত সংশয় তৈরি হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড় আসনটিকে ঘিরে। ওই কেন্দ্র থেকে দীর্ঘ দিনের বিধায়ক বর্তমান বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। কিন্তু সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হিসাবে বছরখানেক আগে দায়িত্ব নেওয়ার পরে সূর্যবাবু এ বার আর ভোটেই দাঁড়াতে চান না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুরও একই মত। কিন্তু সূর্যবাবু প্রার্থী না হলে নারায়ণগড় রক্ষা করা মুশকিল, এই যুক্তি দেখিয়ে বেঁকে বসছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম। এবং তাতে সমর্থন রয়েছে দলের রাজ্য নেতৃত্বের বড় অংশেরও। আবার দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম নেতৃত্বও যাদবপুর আসন থেকে সূর্যবাবুকে প্রার্থী করার প্রস্তাব দিয়ে বসে আছেন। যার ফলে আলিমুদ্দিনের অন্দরে ধন্দ ঘোরালো!
বস্তুত, এ শুধু একটি-দু’টি বিধানসভা আসনে প্রার্থী বাছাই ঘিরে সঙ্কট নয়। সঙ্কট আসলে আরও গভীরে! কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হোক বা না হোক, আসন্ন বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামফ্রন্টের মুখ কে? সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের কি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া উচিত?
এই প্রশ্নের এক কথায় উত্তর মিলছে না সিপিএমে। বুদ্ধবাবু, নিরুপম সেন, গৌতম দেবদের মতো অতীতের বহু পরিচিত এক ঝাঁক মুখকেই এ বার আর বিধানসভা ভোটের ময়দানে দেখা যাবে না। তরুণ, নতুন মুখদের নিয়েই ভোট-যুদ্ধে নামবে আলিমুদ্দিন। কিন্তু সেই বাহিনীর সেনাপতি বাছতে গিয়েই দেখা দিয়েছে সমস্যা!
দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মত, গত পাঁচ বছরে বিরোধী দলনেতা হিসাবে সূর্যবাবু যে ভাবে সামনের সারিতে এসেছেন, তাতে তিনিই এখন সামনে রাখার মতো মুখ হতে পারেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্য সম্পাদকেরা ভোটে লড়তে যাননি। প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়, অনিল বিশ্বাস বা বিমানবাবুরা সংগঠনই দেখতেন। জ্যোতি বসু, বুদ্ধবাবুদের কাঁধে ছিল সরকারের দায়িত্ব। সুদূর অতীতে জ্যোতিবাবু অবশ্য অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্পাদক এবং বিরোধী দলনেতার ভূমিকা একসঙ্গে পালন করেছিলেন।
এই বিতর্কের মীমাংসা হওয়ার আগেই নারায়ণগড়ে সূর্যবাবুকে প্রার্থী চেয়ে চাপ বাড়িয়েছেন জেলা সিপিএম নেতৃত্ব। প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা বাছাই করে রাজ্যে পাঠানোর জন্য জেলাগুলিকে ৯-১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে আলিমুদ্দিন। কয়েক দিন আগে সূর্যবাবুর উপস্থিতিতেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটির বৈঠকে একাধিক নেতা নারায়ণগড়ে প্রার্থী না বদলানোর জন্য সওয়াল করেছেন। গত পঞ্চায়েত এবং লোকসভা ভোটের পরিসংখ্যানের নিরিখে নারায়ণগড়ে পিছিয়ে রয়েছে সিপিএম।
জেলা নেতাদের বড় অংশের আশঙ্কা, তেমন গ্রহণযোগ্য নতুন মুখ না পেলে ওই আসন বার করা কঠিন। সূর্যবাবু প্রার্থী হলে তাঁর ওজনে আসনটা টানা যেতে পারে।
জেলা কমিটির বৈঠকে সূর্যবাবু অবশ্য বলেছেন, প্রার্থী নিয়ে এমন প্রশ্নের মীমাংসা জেলায় সম্ভব নয়। রাজ্য স্তরে আলোচনা করেই যা ঠিক হওয়ার, হবে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম নেতৃত্বও মনে করছেন, বুদ্ধবাবুর পুরনো কেন্দ্র যাদবপুর পুনরুদ্ধার সম্ভব সূর্যবাবুর মতো কাউকে প্রার্থী করলে। তাঁদের প্রস্তাবও মীমাংসার অপেক্ষায় আছে।
দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘মানুষ প্রশ্ন করতেই পারেন, আপনাদের লড়াইয়ের মুখ কে? এক কথায় এর উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতি এখনও নেই। কিন্তু বাস্তব বিচার করলে বলতে হয়, গত পাঁচ বছরের পারফরম্যান্সের পরে দল ও বামফ্রন্টে সূর্যবাবুর গ্রহণযোগ্যতাই এখন সব চেয়ে বেশি।’’
কিন্তু সেখানে বাধা হয়ে আসছে ভোটে না লড়ার যুক্তিই!
সিপিএমের একাংশের প্রশ্ন, কঠিন সময়ে সংগঠন এবং সংসদীয় রাজনীতি আলাদা রাখার ‘বিলাসিতা’র দিন কি আর আছে? সীতারাম ইয়েচুরি এখন সাধারণ সম্পাদক। আবার সংসদে এখন তাঁকে ছাড়া সিপিএমকে ভাবা মুশকিল! একই যুক্তি রাজ্যেই বা প্রযোজ্য হবে না কেন?