হাওড়ার ত্রাস ছাঁট-মাফিয়া অমিত এ বার নাগালে

একের পর এক খুন। বন্দুকবাজি। ব্যবসায়ীদের নিত্যদিন হুমকি-ফোন। কোটি কোটি টাকা তোলা আদায়। গোপন ডেরা থেকে টানা দেড় দশক এমন সব কীর্তিকলাপ চালিয়ে গেলেও এত দিন যার নাগাল পাওয়া যায়নি, ছাঁট লোহার আন্তঃরাজ্য ডন সেই অমিত চৌধুরিকে অবশেষে হাতে পেতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ। হাওড়ায় দু’টি খুন-সহ এ রাজ্যে পাঁচ-ছ’টি ফৌজদারি মামলায় সে মূল অভিযুক্ত।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস ও শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৪ ০৪:০১
Share:

একের পর এক খুন। বন্দুকবাজি। ব্যবসায়ীদের নিত্যদিন হুমকি-ফোন। কোটি কোটি টাকা তোলা আদায়।

Advertisement

গোপন ডেরা থেকে টানা দেড় দশক এমন সব কীর্তিকলাপ চালিয়ে গেলেও এত দিন যার নাগাল পাওয়া যায়নি, ছাঁট লোহার আন্তঃরাজ্য ডন সেই অমিত চৌধুরিকে অবশেষে হাতে পেতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ। হাওড়ায় দু’টি খুন-সহ এ রাজ্যে পাঁচ-ছ’টি ফৌজদারি মামলায় সে মূল অভিযুক্ত। হাওড়া পুলিশ ও সিআইডি-সূত্রের খবর: গত ১২ জুন বিহারের সীতামড়ি জেলার আদালতে অমিত আত্মসমর্পণ করেছে। তাকে আনতে হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের বিশেষ গোয়েন্দা-দল বিহার রওনা হয়ে গিয়েছে। কাল, মঙ্গলবার হাওড়া মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অমিতকে হাজির করানোর কথা।

কে এই অমিত চৌধুরি?

Advertisement

পুলিশি-তথ্য বলছে, বছর পঁয়তাল্লিশের অমিত আদতে বিহারের সীতামড়ি জেলার পুপরি থানা এলাকার এক গ্রামের ছেলে। অল্পবয়সে অপরাধে হাতেখড়ি। বিহারে তার নামে চার-চারটে মামলা ঝুলছে, যার একটা খুনের। এর বাইরে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ঝাড়খণ্ড ও অন্ধ্রে একাধিক হত্যাকাণ্ডে অমিত অভিযুক্ত। ওড়িশা-কর্নাটক-ছত্তীসগঢ়েও তার বিরুদ্ধে তোলাবাজি ও অপরহণের মামলা রয়েছে। পুলিশের অভিযোগ: একটা সময়ে ‘অমিত গ্যাং’-ই দেশ জুড়ে রেলের ছাঁট-লোহার নিলাম কার্যত একা হাতে নিয়ন্ত্রণ করত। যে সব ব্যবসায়ী নিলামের মাধ্যমে হাজার হাজার টন ছাঁট লোহা কিনতেন, তাঁদের থেকে টনপিছু চারশো-পাঁচশো টাকা ‘কমিশন’ বা ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ আদায় করত। “বছর ছয়েক আগে গ্যাংয়ের এক জনকে জেরা করে জানা গিয়েছিল, অমিত এ ভাবে বছরে অন্তত বিশ কোটি টাকা তোলা আদায় করে।” বলেন রাজ্যের এক গোয়েন্দা-কর্তা।

এবং ছাঁট-নিলামের সূত্রেই পশ্চিমবঙ্গ (মূলত হাওড়া, যা কিনা এ রাজ্যে ছাঁট-লোহা কারবারের অন্যতম কেন্দ্র) হয়ে উঠেছিল অমিত চৌধুরির দুষ্কর্মের অন্যতম ঘাঁটি। যার সুবাদে খুন-জখম-হুমকির স্রোত। বিশেষত কিষেণমণি জৈন হত্যাকাণ্ডের পরে এ রাজ্যের পুলিশ অমিতের খোঁজে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। ২০০৭-এর ২৩ জানুয়ারি লিলুয়ার এক স্কুলের সামনে ওই ব্যবসায়ীকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। সিআইডি-তদন্তে জানা যায়, কিষেণমণির কাছে অমিত ৭০ লক্ষ টাকা তোলা চেয়েছিল। তোলা না-পেয়ে খুনের মতলব আঁটে। কিষেণমণিকে নিকেশের জন্য তার শাগরেদরা বিহারের সমস্তিপুরে গিয়ে তিন ‘শার্প শুটার’-কে দশ লাখ টাকার ‘সুপারি’ দিয়ে আসে। ওই ভাড়াটে খুনিরা তার হয়ে কাজ সারে।

পশ্চিমবঙ্গে অমিতের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা রুজু হয় ২০০১-এ। হাওড়ার বালি থানায়, সজ্জন অগ্রবাল নামে এক ব্যবসায়ীর পায়ে গুলি করার ঘটনায়। কলকাতার মানিকতলা থানায় অমিতের নামে তোলাবাজির মামলা দায়ের হয় ২০০৯-এর মার্চে, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের এক লোহা-ব্যবসায়ীর অভিযোগের ভিত্তিতে। প্রায় একই সময়ে লালবাজারের স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর গোয়েন্দারা জানতে পারেন, কলকাতায় অলঙ্কার প্রস্তুতকারী এক সংস্থার মহিলা ডিরেক্টরকে গুম করে মোটা মুক্তিপণ আদায়ের ছক কষেছে অমিত। পুলিশ আগেভাগে টের পেয়ে যাওয়ায় ছক ভেস্তে যায়।

তবে যে মামলায় হাওড়া আদালতে অমিতকে হাজির করাতে এ মাসের গোড়ায় সীতামড়ি কোর্টে হাজিরা পরোয়ানা জমা পড়েছে, সেটি অন্য মামলা সঞ্জয় সিংহ হত্যা। ঘটনাটি কিষেণমণি খুনেরও বছর দুয়েক আগের। বালি থানা-এলাকায় ছাঁট-লোহা কারবারের বড় আড্ডা বজরঙ্গবলি বাজারে ঢোকার পথে খুন হয়েছিলেন ব্যবসায়ী সঞ্জয়বাবু। এতেও মূল অভিযুক্ত অমিত। গোয়েন্দা-সূত্রের যুক্তি: কিষেণমণি-হত্যায় ধৃতেরা উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছে। এমতাবস্থায় একই মামলায় অমিতকে হেফাজতে চাওয়াটা ঝুঁকির হয়ে যেত। তাই সঞ্জয় খুনের মূল অভিযুক্ত হিসেবেই অমিতের হাজিরা পরোয়ানা বিহারে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজ্য পুলিশের এক অফিসার।

অমিত এত দিন ছিল কোথায়?

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দাবি, এ রাজ্যের গোয়েন্দাদের তাড়া খেয়ে সে ২০০৭-এ রাজস্থানের জয়পুরে গিয়ে গা ঢাকা দেয়। পরে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যায় একটি পড়শি রাষ্ট্রে, যেখানে ঢুকতে ভারতীয়দের পাসপোর্ট-ভিসার দরকার পড়ে না। পুলিশ জানিয়েছে, অমিত সিংহ পরিচয় নিয়ে গত ক’বছরে সে ওখানে আবাসন-হোটেলের রমরমা ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। সঙ্গে চলছিল এ দেশের ব্যবসায়ীদের দূরভাষে তোলা-হুমকি। এ বছরও মে মাসে হাওড়ায় তোলা চেয়ে এক ব্যবসায়ীকে মারধরের অভিযোগে অমিতের বিরুদ্ধে বালি থানায় মামলা হয়েছে।

এখন সে হঠাৎ ধরা দিতে গেল কেন? পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দাদের একাংশের ব্যাখ্যা: ইদানীং তোলাবাজির উপার্জনে টান পড়ায় অমিত কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। বস্তুত বছর চারেক আগে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী রূপেশ কুমারের সঙ্গে মনোমালিন্য শুরু হওয়া ইস্তক রোজগারে একটু একটু করে ভাটা ধরেছে। দলও ভেঙে টুকরো-টুকরো। উপরন্তু হাওড়ায় ছাঁট-লোহার কারবারের সেই রমরমা নেই। অনেক লোহা-ব্যবসায়ী কারবার পাল্টে প্লাস্টিক দানা তৈরির মতো নতুন উদ্যোগ শুরু করেছেন। খাস বজরঙ্গবলি বাজার তল্লাটে বিস্তর লোহার কারখানা ঝাঁপ ফেলেছে, সেখানে ফ্ল্যাট উঠছে।

অমিতের আত্মসমর্পণের পিছনে ‘প্রতিকূলতা’র এ হেন বিবিধ ভূমিকার কথা বলা হচ্ছে পুলিশ-সূত্রে। গোয়েন্দাদের একাংশ অন্য তাগিদও দেখছেন। এই মহলের তত্ত্ব: অমিতের একদা ঘনিষ্ঠ সহযোগী তথা ভায়রাভাই উল্লাস পাণ্ডে অধুনা বিহারের রাজনীতির এক বড় কারবারি। আর উল্লাসের পরামর্শেই অমিত ধরা দিয়েছে, যাতে কিনা ভবিষ্যতে সে-ও রাজনীতির ময়দানে খুঁটি গাড়তে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন