বাঁ পায়ে একটি ক্ষত। সেখানে স্প্লিন্টার ঢুকেছিল। তিন সপ্তাহ কেটে গেল, শুকোনোর নাম নেই। আহত ব্যক্তি অবশ্য গোড়া থেকেই হাসপাতালে। প্রথম সাত দিন বর্ধমানে, তার পরে কলকাতায়। খাগড়াগড় বিস্ফোরণের একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী সেই আবদুল হাকিমকে শেষমেশ কবে নাগাদ হেফাজতে নিয়ে জেরা করতে পারবে এনআইএ?
শুক্রবার জাতীয় তদন্ত সংস্থার খোদ শীর্ষ কর্তার উপস্থিতিতে আয়োজিত তাবড় অফিসারদের বৈঠকে ঘুরে-ফিরে উঠে এল সেই প্রশ্ন।
পশ্চিমবঙ্গে সফররত এনআইএ’র ডিজি শরদ কুমার এ দিন বিকেলে সল্টলেকে সিআরপি’র অতিথিনিবাসে বৈঠকে বসেছিলেন। এজেন্সির তদন্তকারীরা তাঁর সামনেই হাকিম-প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। বছর তেইশের যুবকটিকে ৯ অক্টোবর বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ থেকে এনে এসএসকেএমে ভর্তি করা হয়েছে। এনআইএ-সূত্রের খবর, হাকিমের ক্ষতস্থানে আগামী সোমবার ফের স্কিন গ্রাফটিং (শরীরের অন্য জায়গার চামড়া কেটে লাগানো) হবে। সে ক্ষেত্রে আরও সপ্তাহখানেকের আগে তাকে হেফাজতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেই ডিজি-কে জানিয়েছেন অফিসারেরা।
এবং এত দিন ধরে হাকিমের হাসপাতালে থাকাটা তাঁদের কাছে যে খুব স্বাভাবিক ঠেকছে না, তেমন ইঙ্গিতও কোনও কোনও অফিসার ডিজি-কে দিয়েছেন বলে এজেন্সি-সূত্রে জানা গিয়েছে। এনআইএ’র বক্তব্য: হাকিমকে এসএসকেএমের কেবিনে কয়েক দফায় যেটুকু জেরা করা গিয়েছে, তাতে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। বীরভূমের মহম্মদবাজারের দেউচা গ্রামের বাসিন্দাটি নিজেকে জমিয়ত-উল-মুজাহিদিনের সদস্য হিসেবে দাবি করে জানিয়েছে, তিন বছর ধরে সে জঙ্গি কার্যকলাপে লিপ্ত। বর্ধমানের স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতার সঙ্গে খাগড়াগড়-কাণ্ডের কুশীলবদের নিয়মিত যোগাযোগের কথা সে স্বীকার করেছে। পাশাপাশি ভারত ও বাংলাদেশের নানা শহরে একযোগে ধারাবাহিক নাশকতার ছক সম্পর্কেও হাকিমের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
সন্ত্রাস-যজ্ঞের এ হেন চক্রীকে হাতে পাওয়া নিয়ে এনআইএ’র মনে প্রশ্ন জেগেছে কেন?
কারণ, গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা। ১১ অক্টোবর এসএসকেএমে হাকিমের পা থেকে স্প্লিন্টার বার করা হয়। হাসপাতালের এক কর্তা ও হাকিমের স্বাস্থ্যে নিয়মিত নজরদার চিকিৎসকদের এক জন ১৫ তারিখে জানিয়েছিলেন, পর দিনই হাকিমকে ছেড়ে দেওয়া হবে। “এমন লোককে হাসপাতালে রাখাটা বেশ ঝুঁকির। রোগীদের তো বটেই, আমাদের পক্ষেও।”— মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এ-ও বলেন, “আমরা ১৪ তারিখেই হাকিমকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এনআইএ বলেছে, প্রস্তুতির জন্য ওদের একটা দিন দরকার। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে, ১৬ তারিখে ছাড়া হবে।” এসএসকেএমের কর্তাটি সে দিন জানিয়েছিলেন, স্প্লিন্টার বার করার পরে চার দিন বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। রোগীকে আর হাসপাতালে ভর্তি রাখার প্রয়োজন নেই। শুধু নিয়মিত ড্রেসিং দরকার।
কিন্তু রাতারাতি মত বদলে যায়।
১৬ তারিখ সকালে হাকিমকে হেফাজতে নেওয়ার জন্য হাসপাতালে গিয়ে এনআইএ’র অফিসারেরা জানতে পারেন, তার ক্ষতস্থানের সিটি স্ক্যান-সহ বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বেলা বারোটা নাগাদ হাসপাতালের তরফে ওঁদের জানানো হয়, হাকিমকে ছাড়া যাবে না, কারণ সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট আসেনি। অফিসারেরা তার পরেও অপেক্ষা করেছিলেন। বিকেলে তাঁদের বলা হয়, পর দিন, অর্থাৎ ১৭ অক্টোবর হাকিমের স্কিন গ্রাফটিং হবে। ১৭ তারিখ গ্রাফটিংয়ের পরে এসএসকেএম-সূত্রে বলা হয়, কালীপুজোর এক দিন আগে বা পরে হাকিমকে ছাড়া হবে।
এরই মধ্যে ২২ তারিখে খাগড়াগড়-কাণ্ডের মামলা শুনানির জন্য ওঠে। এনআইএ কোর্টকে জানায়, এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষ হাকিমের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে এক-এক সময়ে এক-এক রকম কথা বলায় তদন্ত-পরিকল্পনা ছকতে সমস্যা হচ্ছে। কলকাতার নগর দায়রা আদালতের ভারপ্রাপ্ত মুখ্য বিচারক এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষকে সে দিন নির্দেশ দেন, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে হাকিমের শারীরিক অবস্থা সংক্রান্ত বিস্তারিত রিপোর্ট আদালতে পেশ করতে হবে। এবং সে দিন রাতেই এসএসকেএম থেকে লিখিত ভাবে এনআইএ-কে জানানো হয়, হাকিমের ক্ষতস্থান শুকোচ্ছে না। গ্রাফটিং সফল হয়নি। তাই ২৭ অক্টোবর ফের গ্রাফটিং হবে।
হাকিমের শারীরিক অবস্থা ঠিক কী রকম? এসএসকেএমের সেই কর্তাটিই এ দিন বলেন, “কিচ্ছু বলা যাবে না। মুখ খোলা বারণ।” আর এক কর্তার মন্তব্য, “হাকিমের ব্যাপারে এমনিতেই চাপে রয়েছি। ওকে ছাড়ার কথা বলে বাড়তি চাপ নিতে চাই না।” হাকিমকে না-ছাড়ার জন্য কারা চাপ দিচ্ছেন জানতে চাইলে কর্তাটি এড়িয়ে যান।
খাগড়াগড়-কাণ্ডে বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জার প্রাথমিক রিপোর্টেই বলা ছিল, ২ অক্টোবর বিস্ফোরণের কিছুক্ষণ বাদে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে, হাকিম জখম অবস্থাতেই স্ত্রী আলিমা বিবির সঙ্গে মিলে কিছু কাগজপত্র, মোবাইল ও সিমকার্ড আগুনে ফেলে দিচ্ছে। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ও জঙ্গি-যোগের প্রমাণ নষ্ট করাই ওদের মতলব ছিল বলে রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন এসপি। ৩ অক্টোবরে পাঠানো রিপোর্টটি গিয়েছিল সিআইডি-র এডিজি রামফল পওয়ারের কাছেও। ৩ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সিআইডি-র হাতেই ন্যস্ত ছিল খাগড়াগড়ের তদন্তভার। অথচ ওই আট দিনে সিআইডি একটি বারও হাকিমকে জেরা করেনি! কেন? সিআইডি-র এক অফিসারের ব্যাখ্যা, “ভেবেছিলাম, ও তো হাসপাতালে আছে, সুস্থ হলে জেরা করা যাবে। আমরা তল্লাশি অভিযান আর ধৃত দুই মহিলাকে (রাজিয়া-আলিমা) জেরায় জোর দিয়েছিলাম।’’ অন্য দিকে এনআইএ জানাচ্ছে, হাসপাতালে হাকিমকে অল্প জেরা করেই তদন্ত বিস্তর এগিয়েছে। “হেফাজতে নিলে ওকে দীর্ঘ সময় ধরে জেরা করা যাবে। জঙ্গি চাঁইদের অনেকের ছবি দেখানো যাবে, বাজেয়াপ্ত কিছু নথি সম্পর্কেও সে তথ্য দিতে পারে। এ সব হাসপাতালে সম্ভব নয়।”— বলছেন এনআইএ-র এক অফিসার। সে জন্য ওঁদের এ ভাবে অপেক্ষায় রাখা হচ্ছে কেন?
এসএসকেএমের অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের বক্তব্য, হাকিমের পায়ের ক্ষতটাই গোড়া থেকে সমস্যায় ফেলেছে। হাসপাতালে ওর চিকিৎসার জন্য তৈরি মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যেরা তার শরীরে অন্য সমস্যা খুঁজে পাননি। প্রদীপবাবুর কথায়, “ক্ষতস্থান না-শুকোনোয় গ্রাফটিংয়ের সিদ্ধান্ত হয়। এ সব ক্ষেত্রে তা-ই হয়। কিন্তু হাকিমের গ্রাফটিং সফল হয়নি। এমন নজিরও বহু রয়েছে। সবই আদালতকে জানানো হবে।”
চিকিৎসকেরা জানান, সোমবার ফের গ্রাফটিংয়ের পরে অন্তত এক সপ্তাহ হাকিমকে হাসপাতালে থাকতে হবে। তার পরে ওকে হাসপাতালে রাখার কোনও কারণ নেই। বস্তুত বেশি দিন রাখা হলে হাসপাতাল থেকেই হাকিমের সংক্রমণ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কায় ডাক্তারদের কেউ কেউ। তাঁদের মতে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাকিমকে ছুটি দেওয়াই শ্রেয়।
হাকিমের দ্রুত হাসপাতাল-মুক্তি সম্পর্কে এনআইএ তবু সংশয়ে। ওদের সংশয় অমূলক কি না, আগামী সপ্তাহেই পরিষ্কার হবে।