নীলিমা বাগ(নিহত অপর্ণা বাগের মেয়ে)
একটা বুলেট শুধু একটা মানুষকে নয়, এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে পারে আস্ত একটা সংসারকেও। পনেরো মাস আগে, ২৩ নভেম্বর জমি বাঁচাতে গিয়ে খুন হল মা। বাড়িতে অভাব ছিল ষোলো আনা। কিন্তু তারপরেও আমরা ভাল ছিলাম, জানেন। মা স্বপ্ন দেখত আমরা সবাই লেখাপড়া শিখে নিজে পায়ে দাঁড়াব। তারপরেই সংসারের শ্রী ফিরবে। বাড়তি দু’পয়সা ঘরে ঢুকবে।
দিনের মধ্যে কতবার যে মা এই কথাগুলো বলত তার ইয়ত্তা নেই। আর সেই স্বপ্নপূরণের জন্য দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করত। চাষের কাজ, বিড়ি বাঁধা, ছাগল-মুরগি পালন। কিছু বলতে গেলেই বলত, ‘‘তোরা রোজগার করতে শুরু করলেই তো আমি বসে বসে খাব। এত ভাবছিস কেন?’’
অথচ মায়ের মৃত্যুর পরে সব কেমন হয়ে গেল। মায়ের চলে যাওয়া, মামলা তুলে নেওয়ার জন্য লঙ্কার লোকেদের প্রবল চাপ, লক্ষ লক্ষ টাকার প্রলোভনকে উপেক্ষা— লাগাতার চাপে চোখের সামনে এই পনেরো মাসে বাবাও কেমন বুড়ো হয়ে গেল। বিধ্বস্ত চেহারাটা দেখলেই কেমন কষ্ট হয়।
মায়ের সবথেকে ন্যাওটা ছিল দাদা। মা চলে যাওয়ার পরে ও একেবারে চুপ মেরে গিয়েছে। মাসকয়েক পরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসল বটে, তবে পাশ করতে পারল না। সেই বছরেই উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে আমিও পাশ করতে পারলাম না। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে পড়াটাও ছেড়ে দিতে হল। নাহলে সংসারটাই তো ভেসে যেত। তবে বোনকে স্কুলে পাঠাই। আর কেউ না পারুক, ও অন্তত মায়ের স্বপ্নটা পূরণ করুক।
জানেন, হেঁশেলে ঢুকলেই মায়ের গন্ধ পাই। মশলার কৌটো, তেলের শিশি— সবকিছুতেই তো মায়ের স্পর্শ লেগে রয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশকাকুর ফোনটা এসেছিল—‘১১ জনেরই ফাঁসি হয়েছে।’ ফোনটা রেখে জড়িয়ে ধরেছিলাম বোনকে। ওকে বলেছি লেখাপড়া যেন বন্ধ না করে। দাদা ও বাবাকেও বলেছি, আমরা সবাই দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইটা চালিয়ে যাব। মায়ের মতোই। তাহলেই মা খুশি হবে।