বিধ্বস্ত বাগদাদ। বিস্ফোরণের পর চলছে উদ্ধারকাজ। রবিবার। ছবি: পিটিআই
সতর্কতা ছিলই। তবু ঠেকানো গেল না রক্তপাত। ঢাকার রেস্তোরাঁ-বিস্ফোরণের আঁচ কাটতে না কাটতেই আরও এক বার রমজান মাসে ভরা বাজারে মানববোমা আর গাড়ি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চলল জঙ্গি-তাণ্ডব। এ বার বাগদাদে। নিহত ১২৬। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ২৫ জন শিশু!
বাগদাদের অন্যতম ব্যস্ত বাজার কারদায় শনিবার মধ্যরাতে জোড়া বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। পুলিশ ও সেনা সূত্রে খবর, বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে ভিড়ে ঠাসা ওই বাজারে এসেছিল এক আত্মঘাতী জঙ্গি। একই সঙ্গে নিজের ‘সুইসাইড ভেস্ট’ আর গাড়িবোমার বোতাম টিপে উড়িয়ে দিয়েছে গোটা বাজার!
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, রমজান মাসে মধ্যরাতের ওই সময়টাতেই ভিড় বাড়ে বাজারে। একে সপ্তাহান্ত, তার উপর সামনেই ইদ। শনিবারও তাই কেনাকাটা করতে বাজারে এসেছিলেন বহু মানুষ। বেছে বেছে সেই সময়টাতেই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন ৮৬ জন। আহত অন্তত ১৭০। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, জমজমাট বাজারে হঠাৎ কানফাটানো আওয়াজে আতঙ্ক তৈরি হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পর পর দুটো বিস্ফোরণ হয়। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে লাগোয়া কাপড় আর বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সারি সারি দোকানগুলোয়। সামনের একটি শপিং মল ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। পুলিশের আশঙ্কা, দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন ভিতরের প্রায় সকলেই। বাজারের এক হকার সইদ করিমির কথায়, ‘‘মনে হয়েছিল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। একটা আগুনের গোলা তেড়ে আসছিল। কোনও দিকে না তাকিয়ে দৌড়তে শুরু করেছিলাম।’’ তিনি জানালেন, ওই দৃশ্য দেখার পরে বাজারে ফিরে যাওয়ার সাহস নেই আর। বন্ধুরা কে কোথায় আছে, জানতে ফোন করতে গিয়েও থেমে গিয়েছেন কয়েক বার। পরে অবশ্য জানতে পেরেছেন, বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আহত অনেকে। নিখোঁজও বহু। এই দিনই উত্তর বাগদাদের শিয়া অধ্যুষিত শাহাব প্রদেশে আরও একটি বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখানে নিহতের সংখ্যা ৫। বিস্ফোরণের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অনলাইনে বিবৃতি দিয়ে দায় নিয়েছে সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। জানিয়েছে, শিয়াদের নিশানা করতেই এই হামলা। পুলিশ জানিয়েছে, বাজারটি সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছে। ঠিক কত দেহ বাজারে রয়েছে, এখনও তা স্পষ্ট নয়। রবিবারও দিনভর উদ্ধার কাজ চালিয়েছে সেনা। হাত লাগিয়েছেন স্থানীয়রাও। বাজার জুড়ে এখনও চাপ চাপ রক্তের দাগ। পড়ে রয়েছে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া গাড়ি। ক্ষতবিক্ষত দেহ শনাক্ত করতে সমস্যা হচ্ছে। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুলিশ ও সেনার একটি সূত্র বলছে, গত সপ্তাহেই আইএস-কে হটিয়ে ফালুজা শহর পুনর্দখল করেছে ইরাকি সেনা। ফালুজার ‘বদলা’ নিতে জঙ্গিরা যে বড় আঘাত হানবে, সেই আশঙ্কা ছিলই। স্বাভাবিক ভাবেই এখন প্রশ্ন উঠছে, এত সত্ত্বেও কেন জোরদার করা হল না নিরাপত্তা?
কাল রাতেই বিস্ফোরণস্থলে গিয়েছেন ইরাকের প্রধানমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হায়দর-আল আবাদি। সেখানে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁকে। বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁর কনভয় ধাওয়া করে। ছোড়া হয় ইট-পাটকেলও। এই বিস্ফোরণের পরে ইন্টারনেটেও ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বহু মানুষ। জঙ্গি-দৌরাত্ম্যে ইরাকের পরিস্থিতি দিন দিন হাতের বাইরে চলে গেলেও প্রশাসন কোনও হেলদোল নেই বলে দাবি করে গত কয়েক মাস ধরেই সরকার বিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছে ইরাক। আম জনতার নিরাপত্তার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। শনিবারের এই বিস্ফোরণে আরও এক বার সেই সুরক্ষার প্রশ্নই তুলে দিয়েছে। জঙ্গিদের পাশাপাশি এই বিস্ফোরণের সম্পূর্ণ দায় সরকারেরও— এমন অভিযোগ তুলে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোয় ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন ইরাকের মানুষ। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, শুধু এই বাজার-বিস্ফোরণই নয়, গত ১১ মে পর পর দু’টি গাড়িবোমায় কী ভাবে ৯৩ জন সাধারণ মানুষ বলি হয়েছেন। তার পরেও কেন হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে সরকার?
সরকারি নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে আজ ইরাকের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে এক দল হ্যাকার। সেখানে বিস্ফোরণে নিহত একটি শিশুর ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের ছবি আপলোড করেছে তারা। সঙ্গে একটি ব্যঙ্গচিত্র। সেখানে দেখানো হয়েছে, ইরাকের চেকপোস্টগুলোতে কী ভাবে গাড়িবোমা শনাক্ত করার ভুয়ো যন্ত্র লাগানো হচ্ছে। যার মধ্যে দিয়ে অনায়াসে বেরিয়ে যাচ্ছে বিস্ফোরক লাগানো গাড়ি!