New Jersey

9/11: আকাশে কালো ধোঁয়া, কী হল ৩ মিনিট আগে

কিন্তু সে দিন ব্রিজে উঠে দেখি সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ির লাইন। আর পুলিশ চিৎকার করছে— ‘গো ব্যাক, গো ব্যাক, ইউ ক্যান নট ক্রস দ্য ব্রিজ।’

Advertisement

দেবযানী বন্দ্যোপাধ্যায়

নিউ জার্সি শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:৩৮
Share:

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসবাদী হামলা ফাইল চিত্র।

গত সপ্তাহভর তাণ্ডব চালিয়ে গেল ইডা। সেই ঘূর্ণিঝড়ে ধূলি-ধূসরিত আমার প্রিয় শহরকে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল কুড়ি বছর আগের এক ধূসর সকালের কথা। চোখের সামনে এখনও ভাসছে— হাডসন নদীর ও-পারে নিউ ইয়র্কের স্কাইলাইনের ওপরে এক অদ্ভুত কালো মেঘের কুণ্ডলী। তখনও জানি না, সেই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে আধুনিক আমেরিকার উপরে সব থেকে মর্মান্তিক সন্ত্রাসবাদী হামলার আখ্যান।

Advertisement

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। আমেরিকান ক্যালেন্ডারের প্রথা অনুসারে ৯/১১। তখন আমাদের কাছে ক্যালেন্ডারের বেশির ভাগ দিনগুলোর মতোই তাৎপর্যহীন। বছর চারেক এসেছি এ দেশে। অন্য দিনের মতোই সকালে উঠে, রেডি হয়ে, আমি ও আমার স্বামী যে যার মতো কাজে বেরিয়ে যাব। ওর কর্মক্ষেত্রে নিউ জার্সিতেই। আর আমাকে যেতে হবে নেওয়ার্ক বে ব্রিজ পেরিয়ে ডাউনটাউন নিউ জার্সিতে।

এই ব্রিজ পেরিয়েই রোজ কর্মক্ষেত্রে যাই। কিন্তু সে দিন ব্রিজে উঠে দেখি সামনে বেশ কয়েকটা গাড়ির লাইন। আর পুলিশ চিৎকার করছে— ‘গো ব্যাক, গো ব্যাক, ইউ ক্যান নট ক্রস দ্য ব্রিজ।’ ব্রিজ পেরোনো যাবে না কেন? প্রশ্ন করার আগেই সামনে তাকিয়ে দেখি, নিউ ইয়র্কের আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। গোটা আকাশটাই যেন ছেয়ে গিয়েছে কালো মেঘে।

Advertisement

নেওয়ার্ক বে ব্রিজের একটা ছোট্ট অংশ থেকে নিউ ইয়র্ক শহরটি দেখা যায়। আরও কাছ থেকে ভাল করে দেখার জন্য রয়েছে দূরবিন। দূরবিনে চোখ দিলেই হঠাৎ অনেক কাছে চলে আসে দূরের শহর। সে দিন যদিও গাড়ি থেকে নেমে দূরবিনে চোখ দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি।

দুর্ঘটনা নাকি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, সেটা ভাবতে ভাবতেই রেডিয়ো চালালাম। উত্তেজিত সংবাদপাঠকের বলা প্রথম যে শব্দটা কানে ধাক্কা মারল সেটা— টেররিস্ট অ্যাটাক!। সন্ত্রাসবাদী হামলা? নিউ ইয়র্কে? এ তো কল্পনার অতীত। তত ক্ষণে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছি। বুঝে গিয়েছি, ব্রিজ পেরিয়ে ও দিকে যাওয়া আজ আর সম্ভব হবে না। ঘড়ির কাঁটায় তখন ৮টা ৪৯। তখনও জানি না, তার ঠিক ৩ মিনিট আগে, ৮টা ৪৬-এ একটি যাত্রিবাহী বিমান ধাক্কা মেরেছে নর্থ টাওয়ারে। তখনও জানি না, আর ১৪ মিনিট পরেই, ৯টা ৩ মিনিটে আরেকটি অপহৃত বিমান গিয়ে ধাক্কা মারবে সাউথ টাওয়ারেও। তখনও দাঁড়িয়ে ছিল টাওয়ার দু’টি। পরে বুঝতে পেরেছি, তার মানে আমি যখন দেখেছি, তখনও টাওয়ারের ভিতরে ছিলেন অসংখ্য মানুষ। মরণ-বাঁচনের মাঝখানে!

গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফেরত চললাম বাড়ির দিকে। রোজকার পরিচিত রাস্তা হাইওয়ে ৯৫ ধরে। ভেরমন্ট-ফ্লরিডা এই ইন্টারসিটি হাইওয়ে ধরেই সব সময়ে যাওয়া-আসা করি। এত ফাঁকা কোনও দিন দেখিনি এই হাইওয়ে। পরে শুনেছিলাম, আরও জঙ্গি হামলা হতে পারে, এই আশঙ্কায় সব ইন্টারসিটি হাইওয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ।

বাড়ি ফেরার পথে ফোন করলাম স্বামীকে। সে তখনও বিশ্বাস করতে চাইছে না যে, সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে আমেরিকায়। আসলে আমাদের সকলেরই একটা যেন ধারণা ছিল— আমেরিকা দুর্ভেদ্য, অজেয় একটা দেশ। এক দিকে অতলান্তিক, আর এক দিকে প্রশান্ত মহাসাগর রক্ষা করছে দেশটিকে। আমেরিকার মাটিতে কখনও কোনও বড় মাপের যুদ্ধ হয়নি, আমেরিকা সব সময়ে অন্য দেশে গিয়ে যুদ্ধ করে এসেছে। সিনেমার পর্দায় নানা বিপর্যয়ের ছবি দেখা গেলেও বাস্তবে এখানে কিছু হবে না— মানুষের মনে এই ধারণাটা ছিল বলেই মনে হয় এখানেই আঘাত করার এই পরিকল্পনা করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা। যাত্রিবাহী বিমান ছিনতাই করে, সেগুলিকেই অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে যে এ রকম ভয়াবহ আঘাত হানা যায়, তা তো আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি!

পরের দিন টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ থেকে থ্যাঁতলানো, ঝলসানো মৃতদেহগুলি বার করে এনে রাখা হচ্ছিল নিউ জার্সি সিটির লিবার্টি স্টেট পার্কে। এখানেই হামলার এক দশক পরে, ২০১১-এ, গড়ে তোলা হয় ‘এম্পটি স্কাই মেমোরিয়াল’। সেই স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে এক দিন হঠাৎ মনে হল, এই লিবার্টি স্টেট পার্কের অনতিদূরেই তো এলিস আইল্যান্ড। যে ক্ষুদ্র দ্বীপটিতে নাম নাম নথিভুক্ত করা হত অভিবাসীদের। ১৮৯২ থেকে ১৯২৪, এই কয়েক বছরে এক কোটি ২০ লক্ষ অভিবাসীর নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল এলিস আইল্যান্ডে। আমেরিকা তো অভিবাসীদেরই দেশ। একশো বছরের বেশি সময় ধরে এই দেশকে আপন করে নিয়েছেন কোটি কোটি অভিবাসী। অভিবাসীদেরও আপন করে নিয়েছে এই বিশাল দেশ।

কুড়ি বছর আগের সেপ্টেম্বরের এক সকাল বদলে দিল সেই ছবিও।

স্মরণে: নিউ জার্সিতে ‘এম্পটি স্কাই মেমোরিয়াল’। ফাইল চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন