ছ’মাসে বদলে গেল অনেক কিছুই। (বাঁ দিকে) ভলোদিমির জ়েলেনস্কি এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।
‘জ়েলেনস্কি ২.০’!
২৮ ফেব্রুয়ারির পর ১৮ অগস্ট। হোয়াইট হাউসে ফের মুখোমুখি হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। তবে ছ’মাস যে বেশ দীর্ঘ সময়, তা বোঝা গেল দু’জনের আচরণ এবং সাজপোশাক সংক্রান্ত পরিবর্তন থেকেই। ফেব্রুয়ারির বৈঠকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প এবং মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের সঙ্গে তুমুল বাগ্যুদ্ধ হয়েছিল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের। জ়েলেনস্কিকে সরাসরি ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে বসেছিলেন ট্রাম্প। এ বার অবশ্য একে অপরের প্রশংসা করলেন দু’জনে। বদলে যাওয়া ইউক্রেন প্রেসিডেন্টকে দেখে মনে হচ্ছিল ইনি যেন, ‘জ়েলেনস্কি ২.০’! ছ’মাসে কী কী বদলে গেল?
গত ফেব্রুয়ারিতে ফুলহাতা টি-শার্ট পরে হোয়াইট হাউসে গিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম এবং কূটনীতিকদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন জ়েলেনস্কি। এ বার অবশ্য সেই সুযোগ দেননি তিনি। পরেছিলেন কালো রঙের জ্যাকেট, কালো শার্ট আর কালো রঙেরই প্যান্ট। অনেকের মতে, এটা ‘প্রায় স্যুটের মতোই’। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের এই পোশাক কূটনৈতিক বিধিসম্মত হয়েছে কি না, তা জানা না-গেলেও ট্রাম্পের শংসাপত্র পেয়ে গিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। বৈঠকে যোগ দিতে হোয়াইট হাউসের পোর্টিকোয় গাড়ি থেকে নামার পরেই করমদর্নের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন ট্রাম্প। তার পরেই জ়েলেনস্কির পোশাকের প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেন, “আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার ভাল লেগেছে।” একাধিক মার্কিন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, ট্রাম্প প্রশাসন জ়েলেনস্কিকে ‘স্যুট’ এবং টাই পরার জন্য আর্জি জানিয়েছে। তবে এর আনুষ্ঠানিক সমর্থন মেলেনি। জ়েলেনস্কি ‘প্রায় স্যুটের মতো’ পোশাক পরলেও টাই পরেননি।
ফেব্রুয়ারির বৈঠকে দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমের সামনেই জ়েলেনস্কিকে আমেরিকার সাহায্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন ভান্স। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন, ‘‘আপনি কি এক বারও আমাদের কাউকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন?’’ আর এক ধাপ এগিয়ে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘‘আপনার (জ়েলেনস্কি) মধ্যে কোনও কৃতজ্ঞতা নেই। এটা খুব একটা ভাল কথা নয়। অনেক হয়েছে।’’ সোমবারের বৈঠকে অবশ্য তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলারও কোনও সুযোগ দেননি জ়েলেনস্কি। অসংখ্যবার তিনি ধন্যবাদ জানান ট্রাম্পকে। বক্তব্যের শুরুতেই তিনি বলেন, “মিস্টার প্রেসিডেন্ট (ট্রাম্প) আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি বিষয়টি নিয়ে ভাবিত, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার চেষ্টার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। হত্যালীলা এবং এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আপনি ব্যক্তিগত ভাবে যে উদ্যোগী হচ্ছেন, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।” রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ভুক্তভোগী শিশুদের দিকে পুতিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে চিঠি দিয়েছিলেন ট্রাম্পের স্ত্রী তথা আমেরিকার ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প। সেই কারণে সোমবার মেলানিয়াকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন জ়েলেনস্কি।
সোমবারের বৈঠকে আপাত ভাবে ট্রাম্প এবং জ়েলেনস্কির মধ্যে কোনও বিবাদ হয়নি বলেই জানা গিয়েছে। তবে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। শুক্রবার আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর থেকে ট্রাম্প যে ভাবে সংঘর্ষবিরতির বদলে শান্তিচুক্তির পক্ষে সওয়াল করছেন, তা নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন’ ইউরোপের দেশগুলি। পুতিনের প্রস্তাব মেনে ট্রাম্প শেষমেশ জ়েলেনস্কিকে ইউক্রেনের জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য করবেন কি না, তা-ও এখনও স্পষ্ট নয়।
বৈঠকের পর ট্রাম্প সমাজমাধ্যমে লেখেন, “আমি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। পাশাপাশি, জ়েলেনস্কি এবং পুতিনের মধ্যে একটি বৈঠকের প্রস্তাবও দিয়েছি। ইতিমধ্যেই সেই বৈঠকের তোড়জোড় শুরু করা হচ্ছে। সেই বৈঠক হওয়ার পর, আমরা একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করব। সেখানে দুই রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন এবং আমিও থাকব।” বৈঠক শেষে জ়েলেনস্কি জানান, সোমবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প এবং ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে অস্ত্র কেনা নিয়ে আলোচনা হয়। ইউক্রেনের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ইউরোপীয় তহবিল থেকে ৯০০০ কোটি ডলার ইউক্রেনকে দেওয়া হবে, যাতে তারা আমেরিকা থেকে অস্ত্র কিনতে পারে।
জ়েলেনস্কির জন্য লাল গালিচা পাতেননি ট্রাম্প। আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে যে রাজকীয় আয়োজন ছিল, সোমবারের বৈঠকের আগে তা ছিল না। তবে ছোট ছোট কয়েকটি মুহূর্ত জানান দিয়েছে যে, ফেব্রুয়ারির বৈঠকের মতো শীতলতা ছিল না সোমবারের হোয়াইট হাউসে। ২৮ ফেব্রুয়ারি পোশাক নিয়ে এক মার্কিন সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন জ়েলেনস্কি। ব্রায়ান গ্লেন নামে সেই সাংবাদিক সোমবার জ়েলেনস্কিকে বলেন, “এই স্যুট পরে আপনাকে দারুণ লাগছে।” হেসে ফেলে ট্রাম্প বলেন, “আরে আমি তো একই কথা বলছিলাম।” তার পরেই খানিক থেমে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, “আপনিই সেই ব্যক্তি না, যিনি শেষ বার (জ়েলেনস্কিকে) আক্রমণ করেছিলেন?” হেসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ওই সাংবাদিককে বলেন, “আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি কিন্তু একই পোশাক পরে রয়েছেন।” জ়েলেনস্কির এই কথা শুনেই হেসে ওঠেন আশপাশের সকলে। হেসে ফেলেন ট্রাম্পও। দূরে বসে হাসতে দেখা যায় ট্রাম্পের ‘ডেপুটি’ ভান্সকেও, যাঁর সঙ্গে ২৮ ফেব্রুয়ারি কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছিল জ়েলেনস্কির।
সব মিলিয়ে, ২৮ ফেব্রুয়ারির জ়েলেনস্কি নন, ১৮ অগস্ট দেখা গেল ‘জ়েলেনস্কি ২.০’-কে।