কোনও এক বাইশে জুন হিটলারের নাৎসি বাহিনী আক্রমণ করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন।
চুয়াত্তর বছর পর, গতকাল, অর্থাৎ সেই বাইশে জুনই, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নিষেধজ্ঞা জারি করল রাশিয়ার উপর।
এই সমাপতনকে ‘নৈরাশ্যজনক’ হিসাবে তুলে ধরে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রক আজ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ‘আমরা ধরে নিচ্ছি যে এটা নিছকই ঘটনাচক্র। বিশেষ নকশা নয়!’
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, নাৎসি আক্রমণের সেই দিনটির এই ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি ‘বিশেষ নকশা’ করে হয়তো তৈরি করা হয়নি। কিন্তু কৃষ্ণসাগরের উপরের আকাশে এখন বারুদের গন্ধ। পরিস্থিতি ক্রমশ অন্ধকার হয়ে উসকে দিচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় অর্থাৎ ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতিকে। মস্কোর ইউক্রেন আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্রমহড়া ক্রমশ এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে। উত্তাপকে আরও এক পর্দা চড়িয়ে গতকাল ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে রাশিয়ার উপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন একঝাঁক সর্বাধুনিক এফ-২২ ফাইটার জেট মার্কিন বিমানপোত থেকে রাশিয়ার দিকে উড়ে যাওয়া কিছু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
এটা ঘটনা যে ঠান্ডা যুদ্ধের সময়কার বিশ্বকূটনীতি আজ সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। বিশ্বায়ন পরবর্তী বিদেশনীতিতে পারষ্পরিক নির্ভরশীলতা বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই। অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তার কারণে একটি দেশের ভালমন্দ নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে অন্য দেশের উপর। বিভিন্ন দেশ নিজেদের মধ্যে গাঁটছড়া বাঁধছে ব্রিকস, জি-২০, সাংহাই কর্পোরেশন, সার্ক, আশিয়ান— এর মতো অসংখ্য ছোট বড় গোষ্ঠীর মাধ্যমে। এক দিকে আমেরিকা অন্যদিকে রাশিয়া— বিশ্বের এই দ্বিমেরু কাঠামো থেকে বদল ঘটে, উঠে এসেছে বহুস্বর।
কিন্তু সম্প্রতি দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে যে সংঘাতের পরিবেশ দেখা যাচ্ছে, তা সেই দ্বিমেরু সংঘাতকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে। আর এই গোটা পরিস্থিতি নয়াদিল্লির জন্য প্রবল অস্বস্তিজনক বলেই মনে করছে কূটনৈতিক শিবির। গত ইউপিএ সরকারের সময় যখন রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে, অস্বস্তি শুরু হয়েছিল তখন থেকেই। সরকার বদল হয়ে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলেও সমস্যা কমেনি উল্টে পল্লবিত হয়েছে। আমেরিকা-সহ পশ্চিম বিশ্ব পাশে দাঁড়ায় ইউক্রেনের। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ছায়াযুদ্ধে ভারতের পক্ষে কোনও একটি নির্দিষ্ট পক্ষ নেওয়া কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশমন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘ঠান্ডা যুদ্ধের সময় যে জোট নিরপেক্ষ নীতি নিয়ে চলছিল ভারত তা এখন কার্যত বাতিল হয়ে গিয়েছে। ভারত এখন অংশীদারিত্বের পথে হাঁটছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া এবং আমেরিকা— উভয় দেশই কৌশলগত ভাবে ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’ রাশিয়া থেকে ভারত বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করে। মস্কোর বহু অত্যাধুনিক সামরিক যৌথ প্রকল্প পাইপলাইন-এ রয়েছে। অন্য দিকে, আমেরিকা এবং পশ্চিমের অন্যান্য অনেক দেশের সঙ্গেই ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে। তার মধ্যে অসামরিক পরমাণু চুক্তিও পড়ে।
এটা ঘটনা যে ন্যাটো, আমেরিকা বা রাশিয়া কেউ-ই এখনও প্রকৃত যুদ্ধ শুরু করেনি। কিন্তু তোপ দাগা চলছে। পারষ্পরিক সংঘাত এবং বাদানুবাদ এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে, যে কোনও সময় সামরিক অভিযান বা সেনা প্রত্যাঘাত শুরু হয়ে যেতে পারে। ইউক্রেনের প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তথা ব্রিকিংস ইনস্টিটিউট (থিংক ট্যাংক)-এর কর্তা স্টিভেন পাইফার গোটা বিষয়টির জন্য দায়ী করছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের আগ্রাসী মনোভাবকেই। তাঁর কথায়, ‘‘গত এক বছরে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী যে ভাবে যথেচ্ছ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে সব কিছু গন্ডগোল হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।’’
গত দেড় দু’সপ্তাহ ধরে দু’দেশেরই সামরিক বাহিনী শঠে শাঠ্যং মনোভাব নিয়ে চলছে। আমেরিকা রাশিয়ারকে মুখের মতো জবাব দেওয়ার জন্য পুরোদস্তুর মাঠে নেমে পড়েছে। মার্কিন বায়ু সেনাবাহিনীর প্রধান ডেবোরা জেমস ঘোষণা করেছেন, অত্যাধুনিক বোমারু বিমানের ঝাঁক তাঁরা শীঘ্রই ইউরোপ অভিমুখে পাঠাতে চলেছেন। যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য, নিজেদের শৌর্য্য জাহির করা। ইতিমধ্যেই গোটা ইউরোপ জুড়ে রাশিয়ার আকাশপথ ঘেঁষে চক্কোর মারছে পেন্টাগনের বি-২, বি-৫২ বোমারু বিমান। ঘুরছে ক্ষেপনাস্ত্র সম্বলিত এফ-১৫ সি এবং এ ১০ বিমানও। এখনও কোনও অভিযান হয়নি, কিন্তু আগেভাগেই আমেরিকা এই গোটা প্রয়াসের নাম দিয়ে রেখেছে ‘অপারেশন আটলান্টিক রিসলভ’। ন্যাটোর হিসাব অনুযায়ী তাদের র্যাডারে গত এক বছরে রাশিয়ার চারশোরও বেশি সামরিক বিমানের অবৈধ গতিবিধি ধরা পড়েছে। গত বছরের থেকে যা নাকি ৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। গতবছর মে মাসে কৃষ্ণসাগরের উপর আকাশপথে মার্কিন সামরিক বাহিনীর মাত্র ১০ ফুট দূরত্বে চলে এলেছিল রাশিয়ার একটি জেট।
ন্যাটোর হুমকি বা আমেরিকার জোটের আস্ফালনের মুখে এখনও পর্যন্ত অকুতোভয় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি তাঁর দর্পিত ঘোষণা, ‘‘কেউ যদি আমাদের ভূখণ্ডে হাত বাড়াতে আসে তা হলে আমরা তো আমাদের সামরিক বাহিনীর দিকেই তাকাব! ন্যাটোই আমাদের সীমান্তে এগিয়ে এসেছে। আমরা যাইনি।’’ সংবাদমাধ্যমে ঝড় তুলে দিয়ে এ কথাও প্রকাশিত হয়েছে যে দেশের পরমাণু অস্ত্র ভাঁড়ারকে আরও কার্যকরী করতে অতিরিক্ত ৪০টি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমুখীন বিশেষ ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করার কথা ভাবছে মস্কো। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, পূর্ব ইউরোপে ঘাঁটি গাড়ার লক্ষ্যে আমেরিকা ট্যাঙ্ক এবং আর্টিলারি বসাতে পারে। সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রকের এক শীর্ষ অফিসার ইউরি ইয়াকুবভ-এর কথায়, ‘‘ঠান্ডা যুদ্ধের পর এমন মরিয়া মনোভাব পেন্টাগনের তরফ থেকে আর দেখা যায়নি। এ বার ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলি নতুন করে সামরিক সংঘর্ষ এবং ধ্বংসমূলক পরিণতির জন্য প্রস্তত হোক।’’