দীপাবলি এখন সিঙ্গাপুরের জাতীয় উৎসব

গরম, একঘেয়ে আবহাওয়া। শীত-গ্রীষ্মের ফারাকই তেমন বোঝা যায় না, হেমন্ত-বসন্ত তো দূরের কথা! তার মধ্যে হঠাৎ সেরাঙ্গুন রোড, রেসকোর্স রোড যখন আলোর সাজে ঝলমলিয়ে ওঠে, মনে পড়ে যায়, শরৎ এসে গিয়েছে, হেমন্তও আর দূরে নেই।

Advertisement

স্বপ্না মিত্র

সিঙ্গাপুর শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৩৪
Share:

আলোর রোশনাই সেরাঙ্গুন রোডে। নিজস্ব চিত্র

সিঙ্গাপুরে সারা বছরই কম-বেশি

Advertisement

গরম, একঘেয়ে আবহাওয়া। শীত-গ্রীষ্মের ফারাকই তেমন বোঝা যায় না, হেমন্ত-বসন্ত তো দূরের কথা! তার মধ্যে হঠাৎ সেরাঙ্গুন রোড, রেসকোর্স রোড যখন আলোর সাজে ঝলমলিয়ে ওঠে, মনে পড়ে যায়, শরৎ এসে গিয়েছে, হেমন্তও আর দূরে নেই। কারণ এই হেমন্তেই তো কালীপুজো আর আলোর উৎসব দীপাবলি।

সিঙ্গাপুরে দেওয়ালি সরকারি ছুটির দিন। আগে এখানে দেওয়ালি উদ্‌যাপন হত ঘরোয়া ভাবে। যে যার ইচ্ছে মতো আলো দিয়ে বাড়ি সাজাত, প্রিয়জনদের উপহার দিত আর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করে হইচই করত। প্রায় ত্রিশ বছর হল ছবিটা বদলেছে। সিঙ্গাপুরে দেওয়ালি এখন জাতীয় উৎসব বলা যায়। শুধু রাস্তাঘাট নয়, মেট্রো, ট্রেন, এমনকি বাসও দেওয়ালির সাজে সেজে ওঠে।

Advertisement

প্রথম দিকে এই সব সাজসজ্জার দায়িত্বে ছিল সিঙ্গাপুর ট্যুরিজ়ম বোর্ড। ২০০১ সাল থেকে ‘লিসা’, অর্থাৎ ‘লিটল ইন্ডিয়া শপকিপারস অ্যান্ড হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশন’-ও উৎসবে যোগ দিয়েছে। সাজসজ্জা ও দেওয়ালি সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার ৩০-৪০ শতাংশ অনুদান আসে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে। বাকিটা বহন করে ‘লিসা’।

সিঙ্গাপুরের অন্যতম প্রধান রাস্তা সেরাঙ্গুন রোড। দিওয়ালি উপলক্ষে প্রায় দু’মাস এই রাস্তা আলোয় ঝলমল করে। মোটামুটি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে আলো দিয়ে রাস্তা সাজানো শুরু হয়ে যায় এবং নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই সাজসজ্জা থাকে। আলোকসজ্জার সঙ্গে থাকে শোভাযাত্রাও। নাচ-গান-নাটকের এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয় পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অনাবাসীদের অ্যাসোসিয়েশন। দেওয়ালির কয়েক দিন আগে থেকেই খোলা ময়দানে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। ইন্ডিয়ান হেরিটেজ সেন্টার থেকে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা হয়, কোনওটাতে শেখানো হয় আলপনা দেওয়া, কোনওটাতে আবার মিষ্টি বানানো।

এই সময়ে সিঙ্গাপুরের ভারতীয় পাড়া ‘লিটল ইন্ডিয়া’য় ঢুকলেই দেখা যায়, থরে থরে নানা ধরনের প্রদীপ বিক্রি হচ্ছে। দেওয়ালি স্পেশ্যাল ‘দীপাবলি ফেস্টিভ্যাল ভিলেজ’ আর ‘দীপাবলি হিপস্টার বাজার’ বসেছে এক মাসের জন্য। সেখানে জামাকাপড়, ঘর সাজানোর বিবিধ উপকরণ, সুস্বাদু মিষ্টি, সবই পাওয়া যাচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে অনেক রকমের বাজিও। সবই শব্দহীন। তবে এই সব বাজি কিন্তু ইচ্ছে মতো যেখানে-সেখানে যখন-তখন পোড়ানোর উপায় নেই। প্রতিটি আবাসনে ম্যানেজমেন্টের তরফে নোটিস দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় কবে, কখন, কোথায় বাজি পোড়ানো যাবে।

দেওয়ালি উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ‘তিমিথি ফায়ারওয়াকিং’। এই চার কিলোমিটার পথ চলা শুরু হয় সেরাঙ্গুন রোডের শ্রী শ্রীনিবাস পেরুমল মন্দির থেকে, শেষ হয় শ্রী মারিয়াম্মান মন্দিরে। ফুল-বেলপাতা দিয়ে সাজানো পিতলের ঘট মাথায় নিয়ে সর্বাগ্রে যান প্রধান পুরোহিত, পিছনে পিছনে ভক্তের ঢল। প্রতি বছর পাঁচ হাজারেরও বেশি উপাসক এই যাত্রায় অংশ নেন।

দিওয়ালির দিন এখানকার রামকৃষ্ণ মিশনে নিষ্ঠার সঙ্গে কালীপুজোও অনুষ্ঠিত হয়। ‘বাংলা ইউনিভার্সাল সোসাইটি’ও বেটি রোডে খুব ধুমধামের সঙ্গে কালীপুজোর আয়োজন করে। সেখানে মাঝরাত অবধি মায়ের পুজো, অঞ্জলি এবং ভোগপ্রসাদের জন্য ভিড় উপচে পড়ে।

কথা হচ্ছিল ‘লিসা’র চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— বহুজাতি, বহুসংস্কৃতির দেশ সিঙ্গাপুর। ভারতীয় ছাড়া অন্য জাতি বা ধর্মের মানুষ যোগ দেন দেওয়ালিতে? তিনি বললেন, ‘‘গত বছর ষাট দিনে চল্লিশ লক্ষ মানুষ এসেছিলেন লিটল ইন্ডিয়ায়। তার মধ্যে ষোলো লক্ষ ছিল ট্যুরিস্ট।’’

সত্যিই তো। এত বছর এখানে আছি। সব সময়ে দেখি, জাতি-ধর্ম-সংস্কৃতি নির্বিশেষে মানুষ যে এখানে শুধু পাশাপাশি থাকেন তা-ই নয়, পরস্পরের উৎসবেও যোগদান করেন। এটাই আসল সিঙ্গাপুর! আর এটাই এখানকার দীপাবলির বৈশিষ্ট্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন