International News

প্রথম একশো দিনেই সমালোচনায় বিদ্ধ ট্রাম্প

আমেরিকার যে রাজ্যে থাকি সেই পেনসিলভ্যানিয়ার গেটিসবার্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর অক্টোবরে (তখনও প্রেসিডেন্ট হননি) ঘোষণা করেছিলেন, প্রথম একশো দিনে তিনি কী করতে চান। গোদা বাংলায়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।

Advertisement

প্রসেনজিৎ সিংহ

ফিলাডেলফিয়া শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৭ ১৭:২৬
Share:

প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কতটা সফল বা ব্যর্থ হলেন ট্রাম্প? ছবি: রয়টার্স

আমেরিকার যে রাজ্যে থাকি সেই পেনসিলভ্যানিয়ার গেটিসবার্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বছর অক্টোবরে (তখনও প্রেসিডেন্ট হননি) ঘোষণা করেছিলেন, প্রথম একশো দিনে তিনি কী করতে চান। গোদা বাংলায়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। বিজিত ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনেরও প্রতিশ্রুতি ছিল, পরাজয়ের পরে যা অপ্রাসঙ্গিক। আগামী ২৯ এপ্রিল ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম একশো দিন পূর্ণ করবেন। মার্কিন মুলুকে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কার্যকাল নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছে কিছুটা আগে থাকতেই। নাটকে শেষ অঙ্ক পর্যন্ত অপেক্ষা করার রেওয়াজ থাকলেও এ ক্ষেত্রে ততটা অপেক্ষা করতে রাজি নয় এখানকার গণমাধ্যম।

Advertisement

অনেকগুলো প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসছে। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কতটা সফল বা ব্যর্থ হলেন ট্রাম্প? শেষ পর্যন্ত আমেরিকা কোন পথে? আমেরিকাকে কি সত্যি মহান করে তুলতে পারবেন ট্রাম্প? কার্যকালের প্রথম একশো দিনের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামার নামও।

সকাল নাকি বলে দেয়, বাকি দিনটা কেমন যাবে। যদি এই আপ্তবাক্য মানতে হয়, তবে এ কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল, ট্রাম্পের সেই সকাল মেঘাচ্ছন্ন। এ দেশের অগ্রগণ্য সংবাদপত্র বা পশ্চিমী গণমাধ্যমগুলির বিচার অন্তত সে কথাই বলছে। ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র এবং ফক্স, সিএনএন অথবা এবিসি-র মতো নিউজ চ্যানেলগুলির কোনওটাই ট্রাম্পের কাজকর্ম নিয়ে উচ্ছ্বসিত তো নয়ই, এমনকী ভাল বলতেও কুণ্ঠাবোধ করছে। ওয়াশিংটন পোস্ট এক মাস আগেই ট্রাম্পের প্রথম একশো দিনের শাসনকে ‘ব্যর্থ’ অভিহিত করেছে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস দেরিতে হলেও একে ‘ভীতিপ্রদ একশো দিন’ বলে উল্লেখ করতে ছাড়েনি। ব্রিটেনের সংবাদপত্র ‘দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ এক ঐতিহাসিককে উদ্ধৃত করে বলেছে, অতীতে কোনও প্রেসিডেন্ট প্রথম একশো দিনে এতটা অসফল হননি।

Advertisement

ক্ষমতায় প্রথম একশো দিনের পর গণমাধ্যমে বারাক ওবামা যতটা প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, ট্রাম্পের ভাগ্যে তার সিকিভাগও জোটেনি। সমালোচকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রথম একশো দিনের মধ্যেই ওবামা আমেরিকার থমকে দাঁড়ানো অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এক ট্রিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ পাশ করিয়ে নিতে পেরেছিলেন মার্কিন কংগ্রেসে। আর অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্পের সবচেয়ে আলোচিত পদক্ষেপটি কংগ্রেস পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই আদালতে ধাক্কা খেয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

ট্রাম্প নিজে অবশ্য এ সব নিয়ে খুব ভাবিত বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, গণমাধ্যমকে তিনি নিয়ত নিন্দামন্দ করে থাকেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে। আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁর সুর পুরোপুরি উল্টো। তাঁর দাবি, নব্বুই দিনে কোনও প্রশাসন এমন সাফল্য দিতে পারেনি। তাঁর কথায়: ‘‘কর্মসংস্থান ফিরে আসছে। বেআইনি অভিবাসন কমছে। আইন এবং ন্যায়ের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা আমেরিকাকে সত্যিই মহান করে তুলছি।’’

আরও পড়ুন: ১৩ মে নাকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে! দাবি ভবিষ্যত্ বক্তা হোরাসিওর

তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলির মধ্যে কঠোর অভিবাসন নীতি প্রণয়ন ছিল অন্যতম। প্রস্তাবিত সেই কঠোর নীতি দিয়েই এক দিকে সন্ত্রাসবাদ আটকাতে চেয়েছিলেন, অন্য দিকে বিদেশে চলে যাওয়া কর্মসংস্থান দেশে ফিরিয়ে আনা তথা সস্তায় বিদেশি শ্রমিকদের দেশে ঢোকা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। সাতটি দেশের উপর আমেরিকায় প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আদালতে নাকচ হয়ে গিয়েছে সাংবিধানিক প্রশ্নেই। আর মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর তোলার জন্য তো ঠিকাদার পেতেই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনের। এইচওয়ান-বি ভিসার নিয়মকানুনে অবশ্য সত্যিই বেশ কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করা হচ্ছে। এত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ভারতীয়রাই।

দেশের স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টিতে আমূল পরিবর্তন আনার কথাও বলেছিলেন ট্রাম্প। ওবামাকেয়ার বাতিল করে নতুন ব্যবস্থা চালু করতে গিয়ে সেখানেও থমকে দাঁড়াতে হয়েছে। মার্কিন কংগ্রেসে সমর্থন পাননি তিনি। প্রস্তাবিত ব্যবস্থা আগের চেয়ে ভাল আদৌ হবে কি না, তা নিয়ে রিপাবলিকানদের মধ্যেই ঘোরতর সন্দেহ থেকে গিয়েছে।

ট্রাম্পের বিরুদ্ধে পথে প্রতিবাদীরা। ছবি: এএফপি

আমেরিকার বাজারের বড় অংশ অধিকার করে থাকা চিনকে ‘কারেন্সি ম্যানিপুলেটর’ বলে চিহ্নিত করবেন বলেছিলেন ভোটের আগে। চিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা কৃত্রিম উপায়ে ডলারের দাম বেঁধে রাখার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি ‘দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল’-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উল্টো সুরই শোনা গিয়েছে ধনকুবের প্রেসিডেন্টের গলায়। ট্রাম্প জানিয়েছেন, চিন মোটেও ম্যানিপুলেটর নয়। সাধারণ আমেরিকাবাসীও তাঁর প্রতিদিনের ব্যবহার্য চারটি জিনিসের মধ্যে অন্তত দু’টি চিনের তৈরি জিনিস ব্যবহার করেন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারও বেশি। এ দেশের সাধারণ চাকরি যা বিদেশে চলে যাচ্ছে বলে মধ্যবিত্ত শ্বেতাঙ্গদের ভোট টেনেছিলেন ট্রাম্প, তারও একটা বড় অংশ তো ও দেশেই। ভোটের আগে চিনের প্রতি সেই তির্যক দৃষ্টি বদলে যাওয়ায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

বিদেশনীতির ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক যে তাঁর পূর্ব অবস্থানের অনুসারী হবে না, সেটাও খানিকটা অনুধাবন করেছেন ট্রাম্প। বিশেষত উত্তর কোরিয়ার আস্ফালন প্রশমিত করতে চিনকেই এখন পাশে চাইছেন তিনি। আমেরিকার সঙ্গে চোখে চোখ রেখেই কথা বলতে চায় চিন। বার বার হুঙ্কারে সেই ইঙ্গিত তারা দিয়ে চলেছে। সেখানে আমেরিকাসুলভ আধিপত্য কী ভাবে বজায় থাকে, সে দিকেও তাকিয়ে রয়েছে গোটা বিশ্ব।

রাশিয়ার নাম তো এ দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো একান্ত অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জুড়ে গিয়েছে। পুতিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ট্রাম্প রাশিয়ার সঙ্গে নতুন সম্পর্কের সূচনা করবেন কি না, তা নিয়েই তো অনেকের কপালে ভাঁজ পড়েছিল একসময়। এ দেশের প্রবীণেরা প্রায় কেউই মেনে নিতে পারছিলেন না সেই সখ্য। তবে সিরিয়ার বিমানঘাঁটিতে আমেরিকার অতর্কিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কের যে অবনতি হয়েছে তা খোলাখুলি জানাতে দ্বিধা করেননি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সিরিয়ায় আসাদ প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সহায় রাশিয়া এবং ইরান। সেই সিরিয়ায় আক্রমণকে রাশিয়ার পক্ষে সহজ ভাবে নেওয়া মুশকিল।

‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি ছাড়া যদি আর কোনও প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসনকে এ দেশের মানুষ এগিয়ে রাখতে চান, সেটা অবশ্যই সন্ত্রাসদমনে তাঁর পদক্ষেপ। সে আফগানিস্তানই হোক বা সিরিয়া। জনমত সমীক্ষাগুলিতেও সেই বিষয়টি সামনে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বা স্বাস্থ্যপরিষেবা ক্ষেত্রে মানুষ যেখানে ট্রাম্পকে ‘এফ’ বা ‘ডি’ গ্রেড দিয়েছেন, সেখানে সন্ত্রাস মোকাবিলায় ‘এ’ দিয়েছেন। যদিও সামগ্রিক বিচারে প্রথম একশো দিনের কাজের মূল্যায়ণে ‘বি’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।

সুতরাং দিনের প্রথম আলো খুব আশা দেখাচ্ছে না আমেরিকাবাসীকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন