কাস্ত্রো বা কিম পরিবারতন্ত্র দেখেও দেখেন না এ দেশের কমিউনিস্টরা

কিউবা এবং উত্তর কোরিয়া নিয়ে এ দেশের কমিউনিস্টরা বড় অস্বস্তিতে রয়েছে। এই দু’টি দেশকেই তারা এতদিন সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রচার করে এসেছে। দেশে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেও কমিউনিস্টদের কিউবা বা উত্তর কোরিয়ায় লালঝান্ডার মোড়কে মোড়া পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করতে শোনা যায় না।

Advertisement

সুকান্ত সরকার

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ ১৩:৪১
Share:

কোরিয়ার কিম ইল সুং এবং কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো।

কিউবা এবং উত্তর কোরিয়া নিয়ে এ দেশের কমিউনিস্টরা বড় অস্বস্তিতে রয়েছে। এই দু’টি দেশকেই তারা এতদিন সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রচার করে এসেছে। দেশে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেও কমিউনিস্টদের কিউবা বা উত্তর কোরিয়ায় লালঝান্ডার মোড়কে মোড়া পরিবারতন্ত্রের সমালোচনা করতে শোনা যায় না। প্রকাশ্যে তো নয়-ই।

Advertisement

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিদেল কাস্ত্রো ও তাঁর পরিবার কিউবা শাসন করছে। ১৯৫৯ সালে বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার পর থেকেই কার্যত ফিদেল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা চলে যায়। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে ১৯৭৬ সালে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট হন। কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা হিসেবেই নিজেকে তুলে ধরেন কাস্ত্রো। আমেরিকার নাকের ডগায় বসে ঘোর আমেরিকা-বিরোধী অবস্থান নেন কাস্ত্রো। কমিউনিস্ট পরিচয়ে পেয়ে যান সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যও। অবশ্য, সোভিয়েত-এর কাছেও কিউবা হয়ে ওঠে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই। কেন না, আমেরিকার দোরগোড়ায় বসে আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলার এমন সুযোগ সোভিয়েত হাতছাড়া করবেই বা কেন!

‘লাতিন আমেরিকার হিরো’ কাস্ত্রো কিন্তু সোভিয়েতের পতনে‌র পরেও কট্টর আমেরিকা-বিরোধিতা ছাড়েননি। ২০০৮-এ ৮৪ বছরের ফিদেল অবসর নেওয়া পর্যন্ত এই কট্টর অবস্থান থেকে কিউবা এক পা-ও সরেনি। ২০০৮-এ কিউবার প্রেসিডেন্ট-এর দায়িত্ব নেন ফিদেলের ভাই ৮০ বছরের রাউল কাস্ত্রো। তারপর থেকেই আমেরিকা-সহ পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কিউবার সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে। ২০১৫-তে কিউবার উপর থেকে আমেরিকা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার সিংহভাগই তুলে নেয়। এখন আমেরিকার পর্যটকরা ভিড় জমাচ্ছে হাভানার সমুদ্র সৈকতে।

Advertisement

যাইহোক বিপ্লব, সমাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা—এহবাহ্য, কিউবায় ৫০ বছর ধরে কাস্ত্রো পরিবারের শাসন চলছে। এটাই আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ফিদেলের পর কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব রাউলের হাতে তুলে দেওয়ায়।

কয়েক দিন আগে হাইড্রোজেন বোমা ফাটিয়ে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে আর একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। উত্তর কোরিয়া। ১৫ এপ্রিল, ১৯১২। উত্তর অতলান্তিকে ডুবে গেল টাইটানিক জাহাজ। সবাই জানে এই তথ্যটা। কিন্তু ওই দিন-ই কোরিয়ার উত্তরাঞ্চলে জন্মেছিলেন এক কমিউনিস্ট গেরিলা নেতা। যাঁকে পরবর্তীকালে উত্তর কোরিয়ায় ‘জাতির পিতা’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিম ইল শুন। সময়টা কোরিয়ার ইতিহাসে পাশ্চাত্য এবং জাপানি ঔপনিবেশের আধিপত্যের। পরবর্তীকালে কিম ইল শুনের নেতৃত্বে দেশে বিপ্লব হওয়ার পর অনেকে এ ভাবেও ব্যাখ্যা করেন, টাইটানিকের ডুবে যাওয়া এবং একই দিনে কিম ইল শুনের পৃথিবীতে আগমন ইঙ্গিতবাহী। হ্যাঁ, আজকের ‘সমাজতান্ত্রিক’ উত্তর কোরিয়ার স্কুল-পাঠ্যেও এই ভাবে ওই দুটি ঘটনাকে এক সূত্রে গাঁথা আছে। থাকবে না-ই বা কেন! চিরকাল-ই তো সমস্ত পারিবারিক শাসনের ভিত্তি হিসেবে সামনে আনা হয় পরিবারের সেই মানুষটিকে যাঁর দেশের মানুষের মধ্যে একটা ইতিবাচক উপস্থিতি রয়েছে। উত্তর কোরিয়াতেও তা-ই হয়েছে।

গোল বেঁধেছে তন্ত্র নিয়ে। কিম ইল শুনের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী ১৯৩০-এ জাপানি শাসকদের তাড়িয়ে দেশে সমাজতান্ত্রিক কাঠামো কায়েম করেছিল। কিম ইল শুন গভীর ভাবেই কমিউনিজমের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তাঁর শৈশবেই বাবা কিম ইয়ঙ জিকের মুখে সোভিয়েত ইউনিয়ন, লেনিন এবং বিপ্লবের গল্প শুনে বড় হয়েছেন। জাপানি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কোরীয়দের প্রতিবাদ ক্রমেই রাজনৈতিক আন্দোলনের চেহারা নিতে শুরু করে। সেই সময় কথা লিখতে গিয়ে কিম ইল শুন জানিয়েছেন তাঁর বাবা তখন একটা কথা প্রায়ই বলতেন, কোরীয়দের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে কমিউনিস্ট আন্দোলনে রূপায়িত করতে হবে। কিম ইল শুনের মাথায় এটা ভাল ভাবেই ঢুকে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি ঠিক সেই কাজটাই করেছিলেন। উত্তর কোরিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু কিমের জীবদ্দশাতেই সেই কাঠামোয় ঘুন ধরেছিল। ১৯৯৪-এ কিমের মৃত্যুর পর দেশের শাসনভার চলে যায় তাঁর-ই ছেলে কিম জঙ ইল-এর হাতে। ২০১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে কিম জঙ উন-ই এখন উত্তর কোরিয়ার শাসক। কিম ইল শুনের মতোই উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং সেনা বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্বে তাঁর ছেলে এবং বর্তমান শাসক তাঁর নাতি কিম জন উন।

কিম পরিবারের শাসনে কেমন আছে উত্তর কোরিয়া? কিম ইল শুন দেশে নানা রকম বিধি-নিষেধ জারি করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তি ছিল, উত্তর কোরিয়ায় নয়া ব্যবস্থা অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের শৈশব অবস্থা চলছে। তাই, তাকে বাঁচাতে এবং তার সুসাস্থ্যের জন্য কিমের ব্যবস্থাপত্রের সমর্থক ছিল প্রায় সমস্ত কমিউনিস্ট দুনিয়া। ভারতের কমিউনিস্টরাও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই, উত্তর কোরিয়ার মানুষ বাক্-স্বাধীনতা-সহ বিভিন্ন মানবিক ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও কোনও কমিউনিস্ট রা কাটেনি। কিমের জীবদ্দশা থেকেই এর শুরু। বাড়তে থাকে নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের অত্যাচারও। ‘সমাজতন্ত্রের স্বার্থে’ তা মেনে নেয় বিশ্বের তাবড় তাবড় কমিউনিস্ট পার্টি।

এই মেনে নেওয়াটা ভারতের অধিকাংশ কমিউনিস্টের কাছে যে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তা কিম-পরবর্তী উত্তর কোরিয়ার ‘কমিউনিস্ট’ শাসকদের প্রতি সমর্থন থেকেই বোঝা যায়। এই শাসকরা হলেন কিমের ছেলে এবং পরবর্তীকালে নাতি। ভারতের কোন কমিউনিস্ট পার্টি কিউবা কিংবা উত্তর কোরিয়ায় কিম পরিবারের বংশানুক্রমিক শাসনের বিরোধিতা করেছে প্রকাশ্যে? এ দেশের কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্র নিয়ে মুখ খুললেও কমিউনিস্ট দুনিয়ার পরিবারতন্ত্র বা একনায়কদের বিরুদ্ধে একটি শব্দও খরচ করে না। একমাত্র মার্কিন বিরোধিতার যুক্তি ছাড়া আর কোনও জুতসই ব্যাখ্যা নেই। এই স্ব-বিরোধী ভূমিকা কি কমিউনিস্ট পার্টিগুলি পাল্টাবে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন