১৩ নভেম্বর জঙ্গি হামলার শিকার, প্যারিসের শতাব্দী প্রাচীন বাতাক্লঁ কনসার্ট হল। ছবি: এএফপি।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। কষ্টটাকে গিলে ফেলে তার পরই তিনি বলে উঠলেন— ‘‘মুখিয়ে রয়েছি, ...কবে প্যারিস যাব। আর তর সইছে না।’’
তিনি জেস হিউ। মার্কিন রক ব্যান্ড ‘ঈগলস অব ডেথ মেটাল’-এর গায়ক। গত ১৩ নভেম্বর, প্যারিসের বাতাক্লঁ কনসার্ট হলে জঙ্গি হানার সময় স্টেজে ছিলেন তিনিই। আবারও ওই স্টেজে উঠতে চান জেস। তা-ও খুব শিগগিরি। ‘‘বাতাক্লঁ এখন বন্ধ। মঞ্চ খুলে দেওয়ার পর আমরাই প্রথম কনসার্ট করতে চাই। কারণ... সে দিন, কয়েক মুহূর্তের জন্য যখন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল মঞ্চ, তখনও সেখানে আমরাই ছিলাম...।’’
সেই অভিশপ্ত দিনটার পর প্রথম সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলেছে ঈগলস। সাক্ষাৎকারের কিছুটা প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল আগেই। বিস্তারিত জানা গেল আজ। হিউ ছাড়াও ব্যান্ডের বাকি সদস্যেরা প্রত্যেকেই জানালেন সে দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
সে দিন এক ঘণ্টা হয়ে গিয়েছিল শো। হঠাৎই কালাশনিকভ হাতে ঢুকল তিন বন্দুকবাজ। এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করল তারা। ‘‘প্রথমে আমি ভেবেছিলাম কোনও পাবলিসিটি অ্যাক্ট। কিন্তু পরমুহূর্তে টের পাই, না। এ রকম কিছুই না। দৌড় লাগায় জেস। ছুটে আসে আমার কাছে। টেনে নিয়ে যায় স্টেজের এক ধারে’’, বললেন গিটারিস্ট এডেন গালিনডো। তিনি জানালেন, এক সময় এক জঙ্গির বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল। নতুন করে গুলি ভরার ফাঁকে তাঁরা তিন জন পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যান। তিনি, হিউ ও ব্যান্ডের কর্মী বুট।
বেরিয়ে আসার পরই হিউ খুঁজতে থাকেন বান্ধবী টুইসডে ক্রসকে। কিন্তু সন্ধান না পেয়ে ফিরে যান ড্রেসিং রুমে। সেখানেও ছিলেন না টুইসডে। হিউ এর পর হলে ঢোকার প্যাসেজের দরজাটা খুলতেই চোখে পড়ে একটা চেহারা। ‘‘বন্দুকবাজ... সেও তত ক্ষণে ঘুরে তাকিয়েছে আমার দিকে। তার পরই গুলির আওয়াজ। দরজার ফ্রেম ঘেঁষে বেরিয়ে গেল গুলিটা,’’ বলছিলেন হিউ। তাঁর চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
ফের পালাতে শুরু করেন ওঁরা তিন জন। ভালর মধ্যে এটুকুই যে পথে টুইসডে-কে খুঁজে পেয়েছিলেন হিউ। ও দিকে, ব্যান্ডের ড্রামার জুলিয়ান ডোরিও একা পড়ে গিয়েছিলেন। ড্রাম আড়াল করে স্টেজের উপরে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকেন তিনি।
সফল হয়েছিলেন ডোরিও। কিন্তু ব্যাসিস্ট ম্যাট ম্যাকজুনকিনস স্টেজের আর এক প্রান্তে আটকে পড়েছিলেন। যত ক্ষণে তিনি বিপদটা আঁচ করতে পেরেছেন, পালানোর আর উপায় নেই। শেষে আশ্রয় নেন একটা ঘরের মধ্যে। সেখানে ঠাসাঠাসি করে ঠাঁই নিয়েছিল অনেকে। সঙ্গে চেনা বলতে ব্যান্ডের ট্যুর ম্যানেজার স্টিভ। ঘরবন্দিদের অনেকেরই রক্তাক্ত অবস্থা। ম্যাকজুনকিনস বলেন, ‘‘ক্রমশ গুলির শব্দটা কাছে আসতে থাকে। টানা দশ-পনেরো মিনিট... গুলি যেন থামছেই না। এক বার থামল, আর তার পরই একটা বীভৎস আওয়াজ। গোটা বাড়িটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল।’’ পরে জানা গিয়েছিল, ওটাই ছিল আত্মঘাতী বিস্ফোরণ।
কান ঘেঁষে গুলি বেরিয়ে গিয়েছিল সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার শন লন্ডনের। চোখের সামনে মরতে দেখেছিলেন অনেককে, যাঁরা একটু আগে তাঁদের জন্য গলা ফাটাচ্ছিল। শুনেছেন, জঙ্গিদের হুঙ্কার। গুলি শরীরের এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার পর তাদের চিৎকার ‘আল্লা হো আকবর’! কিন্তু এর পরও হিউ, ম্যাকজুনকিনস, লন্ডন কিংবা গ্যালিনডো, সকলেই ফিরে যেতে চান প্যারিসে। ফের গানের ঝড় তুলতে চান বাতাক্লঁতে। ম্যাকজুনকিনস বলেন, ‘‘আর একটা কথা বলতে চাই সকলকে— সে দিন দেখেছিলাম রক্তাক্ত অবস্থাতেও কী ভাবে একে অপরকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবাই। প্রিয়জনকে ফেলে পালিয়ে যায়নি কেউ...।’’ সন্ত্রাসকে দূরে ঠেলে সে দিনও জিতে গিয়েছিল ভালবাসা।