থরথর করে কেঁপে উঠেছিল মাটি। গুঁড়িয়ে গিয়েছিল বাড়ি-ঘর। কিন্তু এক জনেরও মৃত্যু হয়নি ৭.৩ মাত্রার ওই ভূমিকম্পে। ঘটনাটি ১৯৭৫ সালের। চিনের হাইচেং প্রদেশের।
ঠিক তার পরের বছর, ১৯৭৬ সালে চিনেরই তাংশাং প্রদেশে ৭.৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্পে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ২৫ হাজার মানুষ।
একই দেশে একটি প্রদেশে ভূমিকম্প এতগুলো প্রাণ কেড়ে নিল, আবার সেই দেশেরই অন্য প্রদেশে প্রাণহানির কোনও খবর নেই! এটা কী ভাবে সম্ভব? তা হলে কি বিজ্ঞানীরা কোনও পূর্বাভাস দিয়েছিলেন?
না, হাইচেং প্রদেশের ক্ষেত্রে এ রকম কোনও পূর্বাভাস তাঁরা দেননি। তবে প্রকৃতি ঠারেঠোরে সতর্ক করেছিল। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, হাইচেংয়ে বড় মাপের ভূমিকম্পের আগে গোটা এলাকায় মাস খানেক ধরে অনেক ছোট ছোট কম্পন হচ্ছিল।
ভূবিজ্ঞানের ভাষায়, এদের বলা হয় ফোর-শক বা ভূমিকম্প-পূর্ব কম্পন। এই কম্পনের সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকায় স্থানীয় প্রশাসন ভয় পেয়ে আগেভাগেই সরিয়ে দিয়েছিল বাসিন্দাদের। তাংশাংয়ের ক্ষেত্রে যদিও সতর্ক হওয়ার সুযোগই মেলেনি।
তবে শুধু প্রকৃতি নয়, ভূকম্প নিয়ে আগাম সতর্ক করতে পারেন বিজ্ঞানীরাও।
কী ভাবে?
খড়্গপুর আইআইটি-র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের গবেষকরা বলছেন, এর একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। ৩০০ বছরের মধ্যে কোনও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় যদি ছ’বার রিখটার স্কেলে সাত বা তারও বেশি মাত্রার কম্পন ধরা পড়ে, তবে প্রতি পঞ্চাশ বছরে সেখানে বড় মাত্রার কম্পনের আশঙ্কা (শতকরা ৫০ ভাগ) থাকে। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা হতে পারে সাত বা আরও বেশি।
সেই হিসেবেই অসম-মেঘালয়-অরুণাচলপ্রদেশের মতো এ দেশের সব থেকে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় ফের একটা বড় কম্পনের সময় এসে গিয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। তবে তার উৎস বা দিনক্ষণ হিসেব করে আগাম বলে দেওয়ার কোনও পদ্ধতি এখনও আবিষ্কার হয়নি বলেই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
খড়্গপুর আইআইটি-র ভূ-পদার্থবিদ শঙ্করকুমার নাথ ও কম্পন-নিরোধক বাড়ি তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণারত অধ্যাপক দামোদর মাইতির ব্যাখ্যা, বিভিন্ন টেকটনিক প্লেটের মধ্যে ঘর্ষণে ওই সব প্লেটের সংযোগস্থলে ছোট ছোট ফাটল তৈরি হয়। তাদের বলে চ্যুতি।
বড় চ্যুতিগুলিকে বলা হয় খোঁচ। নিরন্তর ঘর্ষণে তাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চিত হয়।
ওই সব চ্যুতি এবং খোঁচ কোথায় রয়েছে, ভূ-বিজ্ঞানীরা সেটা শনাক্ত করতে পারেন। যেখানে এই ফাটল আছে, সেই এলাকাগুলিকে ভূমিকম্পপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়। চ্যুতি এবং খোঁচে কত পরিমাণ শক্তি জমা হচ্ছে তারও আগাম আঁচ পেয়ে যান ভূ-বিজ্ঞানীরা। শক্তির সঞ্চয় দেখে কোনও এলাকায় অদূর ভবিষ্যতে কত মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে, সেই পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
এ দেশে কোথায় কোথায় এই ধরনের চ্যুতি বা খোঁচ রয়েছে তার মানচিত্র তৈরি করেছে ভারতের ভূতত্ত্ব সর্বেক্ষণ। তার ভিত্তিতেই অসম-মেঘালয়-অরুণাচলপ্রদেশকে সব চেয়ে ভূকম্পপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। দামোদরবাবু বলেন, অসম-শিলং-অরুণাচলপ্রদেশে এমন অনেক চ্যুতি এবং খোঁচ রয়েছে যেখানে অনবরত শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে। গত ৬০ বছরে ওই অঞ্চলে বড় ভূমিকম্প না হওয়ায় উত্তর-পূর্ব ভারতের ফাটলগুলিতে ইতিমধ্যেই প্রবল পরিমাণ শক্তি জমা হয়েছে। হিসেব অনুযায়ী, সেখানে বড় মাত্রার আর একটি কম্পন হওয়ার সময় চলে এসেছে বলেই মনে করেন আইআইটি-র ওই প্রযুক্তিবিদ।
ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার চিন ও অরুণাচল সীমান্ত, অসমের যোরহাট ও শোণিতপুর এবং নাগাল্যান্ডে কম মাত্রার কয়েকটি ভূকম্প হয়েছে। শুধু গত মাসেই উত্তর-পূর্বে এই ধরনের কম্পনের সংখ্যা ১১টি। তবে তা ‘ফোর-শক’ কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি ভূ-বিজ্ঞানীরা।
তা হলে ‘ফোর-শক’-এর উৎস কী?
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কোনও বড় মাত্রার কম্পনের আগে ফোর-শক হবে কি না, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মাটির নীচে টেকটনিক প্লেটগুলি কী ভাবে নড়াচড়া করছে তার উপরে। তাই কোথায় কোথায় ফোর-শক হবে আর কোথায় হবে না— এই পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। ‘‘সব ভূমিকম্পের আগে ফোর-শক হয় না। তাই ছোটখাটো কম্পন মানেই ফোর-শক, এমনটাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়’’, মন্তব্য এক ভূ-বিজ্ঞানীর।
তা হলে কি ভূকম্পে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর কোনও উপায় নেই?
বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, কম্পন-নিরোধক বাড়ি-ঘর তৈরি করলে ক্ষতি এড়ানো যায় অনেকটাই। কিন্তু এ দেশে সেই ধরনের বাড়ি তৈরিতে অনীহা দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু তা-ই নয়, ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বহুতল নির্মাণের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মও শিথিল বলে অভিযোগ তাঁদের। দামোদরবাবুর কথায়, বিপজ্জনক এলাকায় বাস করতে হলে নিয়ম মেনেই বাস
করতে হবে। সেই নিয়ম যাতে কার্যকর হয়, তার জন্য দরকার আবার প্রশাসনিক কড়াকড়ির। ‘‘ভূমিকম্প হয়ে গেলে হা-হুতাশ করার কিন্তু কোনও জায়গা থাকবে না’’— জানিয়েছেন তিনি।
এই প্রসঙ্গেই মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের উদাহরণ উঠে এসেছে। ৬০ বছর আগে প্রচণ্ড কাঁপুনিতে ওলোটপালট হয়ে গিয়েছিল এই শৈলশহর। কিন্তু তা থেকে শিক্ষা নেয়নি কেউ। গত ষাট বছরে কোনও বড় ভূমিকম্প না হওয়ায় নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই শহরের যত্রতত্র গজিয়েছে কংক্রিটের জঙ্গল। এর মধ্যে মাথা তুলেছে বহুতলও। অসম-মেঘালয়-অরুণাচলের নীচে টেকটনিক প্লেটগুলিতে অনেক শক্তি জমা হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি ওই অঞ্চলে বড় মাপের কম্পন হতে পারে।
প্রবল সেই ভূমিকম্পে শিলং, গুয়াহাটিতে তৈরি হওয়া বাড়ি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা দামোদরবাবুর। তাঁর আরও সংযোজন, ‘‘উত্তর-পূর্ব ভারতের মতো না হলেও শহর কলকাতা কিন্তু কম ভূমিকম্পপ্রবণ নয়। তাই মহানগরেও বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা প্রয়োজন।’’