‘মনে হচ্ছে, হিটলারের কাছে আমার জবাব, বেঁচে আছি’

ছেলেটার বয়স তখন এক বছর আট মাস। কিছুমাত্র না ভেবে একরত্তিটার প্রাণ বাঁচাতে মা অপরিচিত এক নার্সের সঙ্গে তাকে তুলে দিয়েছিলেন ট্রেনে। ১৯৩৯ সালের জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডের পথে। শিশুটির নাম পল আলেকজ়ান্ডার। এখন পল ৮১-র বৃদ্ধ। এত বছর পরে যিনি ফিরে দেখলেন ফেলে আসা পথটুকু। এ বার ট্রেনে নয়, সাইকেলে। সঙ্গে তাঁর ৩৪ বছরের এক ছেলে আর ১৫ বছরের এক নাতিও।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

বার্লিন শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৮ ০৩:২১
Share:

পল আলেকজ়ান্ডার

ছেলেটার বয়স তখন এক বছর আট মাস। কিছুমাত্র না ভেবে একরত্তিটার প্রাণ বাঁচাতে মা অপরিচিত এক নার্সের সঙ্গে তাকে তুলে দিয়েছিলেন ট্রেনে। ১৯৩৯ সালের জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডের পথে। শিশুটির নাম পল আলেকজ়ান্ডার। এখন পল ৮১-র বৃদ্ধ। এত বছর পরে যিনি ফিরে দেখলেন ফেলে আসা পথটুকু। এ বার ট্রেনে নয়, সাইকেলে। সঙ্গে তাঁর ৩৪ বছরের এক ছেলে আর ১৫ বছরের এক নাতিও।

Advertisement

জার্মানিতে হিটলারের জমানায় এমন অসংখ্য ইহুদি শিশুর প্রাণরক্ষায় দেশ থেকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাদের বাবা-মা। প্রকল্পটির নাম ছিল ‘কিন্ডারট্রান্সপোর্ট।’ বিদেশে গিয়ে দু’এক বছরের মধ্যে কিছু শিশু ফের বাবা-মাকে খুঁজে পেয়েছিল। কেউ আবার পায়নি। পল প্রথম গোষ্ঠীতে পড়েন। রবিবার বললেন, ‘‘৭৯ বছর আগে ঘৃণার জার্মানি থেকে ইংল্যান্ডের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছেছিলাম। এত দিন পরে সেই পথে আবার... খুব অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে, হিটলারের কাছে আমার জবাব, বেঁচে আছি। একটা সুখী পরিবারের অংশ হয়ে। তার জন্য গোটা বিশ্বকেও ধন্যবাদ।’’

হাজার কিলোমিটারের পথ। আলেকজ়ান্ডার পরিবারের মতো আরও ৩৯ জন সাইকেল আরোহী এই পথ পাড়ি দিয়েছেন। বার্লিনের ফ্রিডরিশস্ট্রাস থেকে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রিট। এই আরোহীদের অনেকে সেই সময়ে উদ্ধার হওয়া শরণার্থী শিশুর বংশধর। অনেকে আবার ‘ওয়ার্ল্ড জিউইশ রিলিফ’-এর উদ্যোগে এই যাত্রায় যোগ দিয়েছেন সেই শিশুদের কথা মনে রেখে। উদ্যোগের শরিক রফি কুপার বলেছেন, ‘‘যে ভাবে ওই সময়ে বাচ্চাদের রক্ষা করা হয়েছিল, ভাবা যায় না। তাই আমাদের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতে এই যাত্রা।’’

Advertisement

ইহুদি শরণার্থী শিশুদের আশ্রয় দিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেনের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট ও ইহুদি গোষ্ঠী। পুনর্বাসনের কাজ
তার পরে মসৃণ পথেই এগোয়। বার্লিনের এক অনাথাশ্রম থেকে ১৯৩৮ সালের ২ ডিসেম্বর শিশুদের প্রথম দলটি এসে পৌঁছয় ইংল্যান্ডের এসেক্সের হারউইচ শহরে। ওই অনাথাশ্রমটি পরে তছনছ করে দিয়েছিল নাৎসিরা। তার পর থেকে দীর্ঘ ১৮ মাস ধরে ১০ হাজার শিশুকে বাঁচানো হয়েছিল এ ভাবে। ১৯৪০-এর ১৪ মে ছিল ‘কিন্ডারট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্পের শেষ দিন। শুধু জার্মানি নয়, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড এবং সে সময়কার চেকোশ্লোভাকিয়া থেকেও শিশুদের নিরাপদে নিয়ে আসা হয়েছিল ব্রিটেনে। একেবারে ছোট যারা, তাদের রাখা হয়েছিল ব্রিটিশ কোনও পরিবারের কাছে। আর ১৬-র উপরে যারা, তারা পেয়েছিল পেশাগত প্রশিক্ষণ।

কোনওদিন হয়তো সন্তানের মুখ আর দেখতে পাবেন না— এমন ঝুঁকি সত্ত্বেও নাৎসি আগ্রাসন থেকে তাদের বাঁচাতে অচেনা লোকের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন বাবা-মায়েরা। পলের আগে আরও দুই সন্তানকে হারিয়েছিলেন তাঁর মা। তাই বুকে পাথর রেখে একমাত্র সন্তানকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন। যন্ত্রণার অবসান হয়ে তিন বছর পরে। বাবা-মায়ের সঙ্গে ইংল্যান্ডে দেখা হয় পলের। হলোকস্ট-এর (ইহুদি নিধন) হাত থেকে বেঁচে যায় গোটা পরিবারই। পড়াশোনা করে পল আইনজীবী হন। লন্ডনে বিয়ে করেন এক ইজ়রায়েলি মহিলাকে। এখন ৩ ছেলে আর ৯ নাতি-নাতনিকে নিয়ে থাকেন ইজ়রায়েলেই।

পলের ছেলে নাদাভ এখন আড়াই বছরের সন্তানের বাবা। পল-কে সাইকেলে সঙ্গ দেন তিনিই। ঠাকুরমার কথা শুনে নাদাভ বললেন, ‘‘ভাবতেই পারি না আমার এইটুকু বাচ্চাকে কারও হাতে ছেড়ে দিতে পারব! তাকে ফিরে পাব কিনা, সেটা পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। কতটা দৃঢ়চেতা হলে এটা করা সম্ভব, সেটাই ভাবছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন