৯০-এ প্রয়াত ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ

অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চেনা একটা ছবি। ঘন সবুজ জলপাই উর্দি, একমুখ দাড়ি, মুখে বিখ্যাত কোহিবা চুরুট আর একের পর এক সমাজতান্ত্রিক দেশের পতন দেখেও চূড়ান্ত নির্বিকার উক্তি— হয় সমাজতন্ত্র নয় মৃত্যু!

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

হাভানা শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:০৯
Share:

১৯৯৭। হাভানার একটি জনসভায় ফিদেল কাস্ত্রো।—ফাইল চিত্র

অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চেনা একটা ছবি। ঘন সবুজ জলপাই উর্দি, একমুখ দাড়ি, মুখে বিখ্যাত কোহিবা চুরুট আর একের পর এক সমাজতান্ত্রিক দেশের পতন দেখেও চূড়ান্ত নির্বিকার উক্তি— হয় সমাজতন্ত্র নয় মৃত্যু!

Advertisement

সেই ছবিটাই শুক্রবার থেকে অতীত হয়ে গেল এক ধাক্কায়। ৫০ বছর ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র আমেরিকার নাকের ডগায় ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবায় সোভিয়েত ধাঁচের শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়া ফিদেল আলেহান্দ্রো কাস্ত্রো রুজ মারা গেলেন। বিশ্ব যাঁকে চেনে ফিদেল কাস্ত্রো বা ফিদেল নামে। আর লাতিন আমেরিকা জুড়ে তিনিই ‘এল কমান্দান্তে’ (কম্যান্ডার ইন চিফ)। বয়স হয়েছিল ৯০। শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ১০টা ২৯-এ (ভারতীয় সময় শনিবার সকাল)। ফিদেলের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করেন তাঁরই অশীতিপর ভাই তথা বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও কিউবা বিপ্লবের আর এক নায়ক রাউল কাস্ত্রো।

কেউ বলেন, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘজীবী এই নেতা নিজেই ইতিহাস। কেউ বলেন, যে স্বৈরাচার উৎখাত করে তিনি আমেরিকার দোরগোড়ায় সমাজতন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন, দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বৈরাচারের পথে হেঁটেছেন তিনি নিজেও! ১০ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের যাবতীয় হুমকি এবং বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করেই সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে শাসন চালিয়ে গিয়েছেন দাপটে। এড়িয়েছেন ছ’শোরও বেশি খুনের চেষ্টা। আর প্রতি বছর উগরে দিয়েছেন আমেরিকার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ!

Advertisement

স্থানীয় সময় শুক্রবার রাতে জাতীয় টেলিভিশনে দাদা তথা প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করতে গিয়ে রাউল মনে করিয়ে দেন ফিদেলের বিখ্যাত স্লোগান ‘‘টুওয়ার্ডস ভিকট্রি, অলওয়েজ!’’ আগামী ৪ ডিসেম্বর সম্পন্ন হবে ফিদেলের অন্ত্যেষ্টি। ৯ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট রাউল। বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রমাগত এসে জমছে শোকবার্তা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো, চিনের শি চিনফিং— তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।

ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুর খবরে দৃশ্যতই ভেঙে পড়লেন ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা। —ফাইল চিত্র

ফিদেলের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৩ অগস্ট, কিউবার বিরানে। বাবা স্পেনীয় শরণার্থী। মা অবশ্য কিউবারই মেয়ে। ছোটবেলা থেকে খেলাপাগল ফিদেলের স্বপ্ন ছিল আমেরিকার মেজর লিগে বেসবল খেলার। ছোটবেলার সেই স্বপ্ন ক্রমশ ফিকে হতে থাকে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। জেসুইট স্কুলে পড়া শেষ করে আইনজীবী হতে চেয়ে ঢুকলেন হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর সেখানেই ছোটবেলার স্বপ্নের ইতি! সেখানেই মার্কসবাদে দীক্ষা। আদর্শ মেনে নেওয়া স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নকে। ১৯৫২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর কিউবার প্রেসিডেন্ট হলেন মার্কিন ঘনিষ্ঠ ফুলহেনসিয়ো বাতিস্তা। বাতিস্তার শাসনে দ্রুত ক্ষোভ বাড়তে শুরু করল কিউবার অন্দরে। সেটাকে পুঁজি করে বিদ্রোহ ঘটাতে গিয়ে আক্রমণ করলেন মনসাদা সেনা ছাউনি। কিন্তু ব্যর্থ হলেন তরুণ ফিদেল। গ্রেফতারের পরে কারাবাস পর্ব পেরিয়ে লুকিয়ে পালালেন মেক্সিকোয়। সেখানে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হল এক আর্জেন্তিনীয় চিকিৎসকের। এর্নেস্তো চে গেভারা। সেই দলে যোগ দিলেন ভাই রাউল। এই তিন জনের পরিকল্পনার ফসল, ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে বাতিস্তা সরকারের পতন। কিউবার ক্ষমতা দখল করলেন ফিদেল-রাউল-চে।

১৯৫৯ সালে কিউবার প্রধানমন্ত্রী হন ফিদেল। তখন থেকে ’৭৬ পর্যন্ত দেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত দেশের প্রেসিডেন্ট (মাঝে সাময়িক ভাবে অসুস্থতার জন্য ২০০৬-এ প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়েন)। কমিউনিস্ট পার্টি অব কিউবার প্রথম সেক্রেটারি ফিদেল সংগঠনের শীর্ষে ছিলেন ১৯৬১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত।

৯০ বছরের দীর্ঘ জীবনের প্রতি ছত্রে জড়িয়ে বিতর্ক। যত সময় গিয়েছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে তত গলা চড়েছে তাঁর। কিউবার ক্ষমতা দখলের পরেই আমেরিকার সঙ্গে দ্রুত সম্পর্কের অবনতি এবং পরিণামে প্রায় ৬০ বছর ধরে মার্কিন অবরোধ। তবু মাথা নোয়াননি ফিদেল। ১৯৭৩ সালে একবার বলেছিলেন, আমেরিকা সেই দিন কিউবার সঙ্গে কথা বলবে, যে দিন তাদের প্রেসিডেন্ট হবেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ। ঘটনাচক্রে, ওবামা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেই কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করে।

১৯৭৩। কলকাতায় জ্যোতি বসুর সঙ্গে। —ফাইল চিত্র

এক সময় ফিদেল বলেছিলেন, জীবদ্দশায় রাজনীতি ছাড়বেন না। কিন্তু অসুস্থতা এবং অন্ত্রে জটিল অস্ত্রোপচারের পরে ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়েন। নিজের পদে বসান ভাই রাউল কাস্ত্রোকে।

২০০৬ সালে অস্ত্রোপচারের পর থেকেই ক্রমশ সরে যেতে থাকেন লোকচক্ষুর আড়ালে। শরীর ভাঙলেও নিজের আমেরিকা-বিরোধিতা এতটুকুও কমাননি। দীর্ঘ বিরোধিতা, তিক্ততা ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার পর ২০১৬-র মার্চে প্রথম কিউবা সফরে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। কিন্তু ওবামা ওয়াশিংটনের বিমানে চড়ার পরেই তাঁর উদ্দেশে সংবাদমাধ্যমে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন ফিদেল। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কড়া সমালোচনা করে কিউবাবাসীকে ‘প্ররোচনায় পা না দেওয়ার’ ডাক দেন তিনি। কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সেক্রেটরি তাঁর শেষ পার্টি কংগ্রেস বক্তৃতায় বিদায় জানিয়েছিলেন সহযোদ্ধা-সহকর্মীদের। ২০১৬ সালে, কিউবা বিপ্লবের ‘এল কমান্দান্তে’ বলেছিলেন, ‘‘আমি নব্বই ছুঁইছুঁই। এ বার যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু কিউবা এবং সমাজতন্ত্রের মৃত্যু হবে না।’’

চোখের সামনে দেখেছেন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়, পুঁজিবাদের রমরমা। শেষে হয়তো বুঝতে পারছিলেন, বাজার অর্থনীতির যুগে আর খুব বেশি দিন সমাজতন্ত্রের কথা বলে দেশ পরিচালনা করা কঠিন হবে। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করেননি কোনও দিন। আরও একটা জিনিস করেননি। আমেরিকার প্রশংসা। আমেরিকাও অবশ্য করেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কথায়, ‘‘কিউবার মানুষের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেব আমরা।’’ আর আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘‘কিউবার যে বিপর্যয় ফিদেল ডেকে এনেছিলেন, তা মোছার নয়। তবে কিউবার মানুষ যাতে শেষ পর্যন্ত প্রাচুর্য ও স্বাধীনতার পথে এগোতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমার প্রশাসন কাজ করবে।’’

আরও খবর...

সিঁড়ি ভাঙতে স্বপ্ন ‘মেক ইন আমেরিকা’-ই

‘তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম!’ ফিদেলকে লিখেছিলেন চে

সাম্রাজ্যবাদী হিংসার বিরুদ্ধে নীল আকাশের নাম

৬৩৪ বার খুন করার চেষ্টা হয়েছে ফিদেলকে?

আমেরিকার নাকের ডগায় ছোট্ট দ্বীপের স্পর্ধার নাম ফিদেল কাস্ত্রো

‘বিয়ার হাগ’ দিয়ে ইন্দিরাকে চমকে দিয়েছিলেন কাস্ত্রো

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি ফিদেলের ছিল গভীর শ্রদ্ধা

কাস্ত্রোর প্রয়াণে শোকাহত বাংলাদেশ

ফিদেল কাস্ত্রোর প্রয়াণে টুইট করলেন যাঁরা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন