Africa

African Architect: শিকড়ের সন্ধানে আফ্রিকান স্থপতি, কুর্নিশ বিশ্বের

কয়েক দিন আগেই ঘোষণা করা হল এ বছরের প্রিৎজ়কার পুরস্কারপ্রাপকের নাম। এ বারের প্রিৎজ়কারজয়ী স্থপতি দিয়েবেদো ফ্রান্সিস কেরে।

Advertisement

মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়

বস্টন শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২২ ০৭:৩২
Share:

দিয়েবেদো ফ্রান্সিস কেরে (ইনসেটে) ও তাঁর নকশায় তৈরি করা গান্ডো প্রাইমারি স্কুল। ছবি ‘কেরে আর্কিটেকচার’-এর সৌজন্যে।

কয়েক দিন আগেই ঘোষণা করা হল এ বছরের প্রিৎজ়কার পুরস্কারপ্রাপকের নাম। ‘স্থাপত্যবিদ্যার নোবেল’ হিসেবে খ্যাত এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে ১৯৭৯ সাল থেকে। এ বারের প্রিৎজ়কারজয়ী স্থপতি দিয়েবেদো ফ্রান্সিস কেরে। এই প্রথম কোনও কৃষ্ণাঙ্গ এবং কোনও আফ্রিকান এই খেতাব জিতে নিলেন।

Advertisement

পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট, দরিদ্র দেশ বুরকিনা ফাসোর এক অখ্যাত গ্রাম গান্ডোয় জন্ম দিয়েবেদোর। সেখানে ‘স্থাপত্যবিদ্যা’ নিয়ে চর্চা তো দূরের কথা, পানীয় জল আর বিদ্যুৎই ঠিক মতো পাওয়া যেত না। দিয়েবেদোর বাবা ছিলেন গ্রামপ্রধান। তিনি তাঁর বড় ছেলেকে চাষবাসের কাজে না নামিয়ে কেন পড়াশোনা করতে পাঠাচ্ছেন, এটাই তাঁর গ্রামের লোকজন তখন বুঝে উঠতে পারেননি।

দিয়েবেদোর নিজের গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না। পরিবার-পরিজন ছেড়ে তিনি অন্য গ্রামের যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানে স্কুল বলতে শুধু একটা সিমেন্টের ঘর। সেখানেই শ’খানেক পড়ুয়া গরমে প্রচণ্ড কষ্ট করে পড়াশোনা করত। স্কুল পাশ করে স্কলারশিপ জোগাড় করে বার্লিন পাড়ি দেন দিয়েবেদো। প্রাথমিক ভাবে কারিগরি শিক্ষায় পাঠ শুরু করলেও মেধা আর পরিশ্রমের জোরে স্নাতক হন স্থাপত্যবিদ্যায়। আর তার পরে এক স্থপতি হিসেবে ফিরে যান নিজের গ্রামে— বাচ্চাদের জন্য উপযোগী একটা স্কুল তৈরি করতে। সেটা ২০০১ সালের কথা। কেরের কথায়, ‘‘আমার জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বিশ্বাস করে যে, আমাদের প্রত্যেককেই সমাজে কিছু ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই ধারণা থেকেই আমার গ্রামে স্কুল তৈরি করা শুরু করি।’’ ফান্ডরেজ়িং করে টাকা জোগাড় করেন কেরে, স্কুলবাড়ির ডিজ়াইন অবশ্যই তাঁর নিজস্ব। ‘‘প্রতিটি পদে মনে পড়ত প্রচণ্ড গরমে কষ্ট পাওয়া আমার মতো বাচ্চাগুলোর কথা,’’ তখন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কেরে। দেশজ মাটি ও কাঠ দিয়ে তৈরি কেরের স্কুলের নকশার প্রধান লক্ষ ছিল— সূর্যের প্রখর তাপকে কী ভাবে দেওয়ালের বাইরেই আটকে দিয়েও ক্লাসের ভিতরে সূর্যের আলো কতটা ভাল ভাবে ব্যবহার করা যায়। সেই স্থাপত্য সে বছর নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নিয়েছিল।

Advertisement

গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীজুড়ে একের পর এক স্থাপত্যে তাঁর অনন্য শৈলির ছাপ রেখেছেন কেরে। এবং সব জায়গাতেই ইউরোপীয় প্রযুক্তির সঙ্গে ব্যবহার করেছেন দেশজ, সহজলোভ্য উপকরণ। যেমন গান্ডো প্রাইমারি স্কুলের লাইব্রেরিতে ছাদের বিভিন্ন জায়গায় জল আনার বড় বড় মাটির পাত্র লাগিয়েছিলেন কেরে। সেই সব পাত্রের নীচের দিকে বড় বড় ছিদ্র করে দিয়েছিলেন, যাতে সহজেই সূর্যের প্রখর আলো সেই পাত্রে ঢুকে নরম আলো হয়ে লাইব্রেরি ঘরকে আলোকিত করতে পারে। বুরকিনা ফাসোতেই একটি হাসপাতালে কেরে বানিয়েছেন বিভিন্ন উচ্চতার জানলা, যাতে চিকিৎসকেরা দাঁড়িয়ে, ভিজ়িটরেরা বসে এবং রোগীরা শুয়ে বাইরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারেন। এই রকম হরেক কিসিমের নকশায় প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি।

প্রিৎজ়কার পুরস্কার পাওয়ার পরে কেরে এক বক্তৃতায় জানিয়েছিলেন, বুরকিনা ফাসো দেশটা এখনও তেমন কিছু পাল্টায়নি। আজও তেমনই গরীব সেখানকার মানুষ। আজও পানীয় জল, বিদ্যুতের অভাব। সুযোগ পেলে গ্রামের কিছু মানুষ বাইরে চলে যান, কিন্তু তাঁরা আর ফিরে আসেন না। ফলে গ্রামের উন্নতিও হয় না। কেরের কথায়, ‘‘আমি যখন প্রথমবার গ্রামে ফিরে বলেছিলাম, স্কুল তৈরি হবে স্থানীয় মাটি দিয়ে, গ্রামের মানুষজন উল্টে বলেছিলেন, মাটি দিয়ে স্কুল তৈরির শিক্ষা নিয়ে তুমি বিদেশ থেকে ফিরলে!’’ কিন্তু ওই মাটির উপরে দাঁড়িয়েই, মাটির কাছের মানুষদের নিয়ে, একের পর এক ম্যাজিক তৈরি করে গিয়েছেন দিয়েবেদো। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে শুরু করে জেনিভা, লন্ডন, তাঁর স্থাপত্যের নিদর্শন পৃথিবীজুড়ে। তা ছাড়া, তাঁর প্রশিক্ষণেই বুরকিনা ফাসোতে এক তরুণ কর্মী এখন কেরের সংস্থা ‘কেরে আর্কিটেকচার’-এ কাজ করছেন।

‘‘আমার কাজের শিকড় আমার সমাজ,’’ বলেছিলেন কেরে। তাঁর সেই শিকড়ে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টাকেই কুর্নিশ জানালো প্রিৎজ়কার কমিটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন