international news

৪ অফিসার-সহ আটক ১০ ভারতীয় সেনাকে মুক্তি দিল চিন

ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির মেজর জেনারেল পর্যায়ের দু’দিনের দফাওয়ারি বৈঠকেই এ ব্যাপারে বরফ গলে কিছুটা।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

লন্ডন শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২০ ১০:৫৬
Share:

গলওয়ান উপত্যকায় সেনা তৎপরতা। ছবি- পিটিআই।

গলওয়ান উপত্যকায় সোমবার রাতের সংঘর্ষে চিনা সেনার হেফাজতে থাকা চার জন সেনা অফিসার ও ৬ জন ভারতীয় জওয়ানকে বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম শুক্রবার এই খবর দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি। শুধু গত কাল রাতে সেনাবাহিনীর একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “লাদাখে গলওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষে কোনও ভারতীয় জওয়ান নিখোঁজ নেই।’’

Advertisement

সরকারি সূত্রের খবর, কোনও সমাধান সূত্র বেরিয়ে না এলেও ভারতীয় সেনাবাহিনী ও চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির মেজর জেনারেল পর্যায়ের দু’দিনের দফাওয়ারি তিনটি বৈঠকেই এ ব্যাপারে বরফ গলে কিছুটা। চিনা সেনার হাতে আটক থাকা ১০ ভারতীয় জওয়ানকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই বৈঠকে ছিলেন লেহ্‌-তে মোতায়েন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল অভিজিৎ বাপাট ও চিনা সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট ডিভিশনের মেজর জেনারেল। যে ১০ জন ভারতীয়কে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৪ জন সেনা অফিসারও।

ভারতীয় সেনাবাহিনী সূত্রে এও জানানো হয়েছে, সোমবারের সংঘর্ষে গুরুতর জখম ১৮ জন জওয়ানের এখনও চিকিৎসা চলছে। তবে তাঁদের সকলের অবস্থাই স্থিতিশীল। অন্তত ৫৮ জন এক সপ্তাহের মধ্যে কাজে যোগ দিতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

Advertisement

ওই সংঘর্ষে তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে চিন স্বীকার করলেও কত জন চিনা জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে, কত জনই বা জখম হয়েছে, তা সবিস্তারে জানানো হয়নি।

ও দিকে, সোমবার গলওয়ানে কেন হাতিয়ারবিহীন অবস্থায় জওয়ানদের বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধী। জবাবে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘গালওয়ানে যে দলটি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, তাদের হাতে হাতিয়ার ছিল। সীমান্তরক্ষার দায়িত্বে থাকা সব জওয়ানের কাছেই হাতিয়ার থাকে। কিন্তু প্রোটোকল মেনেই তাঁরা তা ব্যবহার করেননি।’’

এহেন প্রোটোকল নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন পঞ্জাবের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী অমরেন্দ্র সিংহ। তাঁর মন্তব্য, ‘‘যখন সঙ্গীরা খুন হচ্ছেন, তখন কেন জওয়ানেরা অস্ত্র ব্যবহার করে পাল্টা জবাব দিলেন না, তা দেশ জানতে চায়।’’

আরও পড়ুন- দ্বিতীয় দিনের বৈঠকও নিষ্ফল, লাদাখে জোর বাড়াচ্ছে চি

আরও পড়ুন- সামরিক, কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চিনকে পিছু হটানোর চেষ্টায় ভারত​

সেনা সূত্রে বলা হয়েছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পাহারার প্রশ্নে ১৯৯৬ ও ২০০৫ সালের প্রোটোকল এবং ‘রুল অফ এনগেজমেন্ট’ অনুযায়ী পাহারার সময়ে হাতে অস্ত্র থাকলেও তা ব্যবহার না-করাই নিয়ম।

যদিও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এস পানাঘের মতে, “যদি প্রাণের আশঙ্কা, ভূখণ্ড বা সিকিয়োরিটি পোস্ট আক্রান্ত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় তা হলে কমান্ডার স্তরের অফিসার তার বাহিনীর হাতে থাকা সমস্ত ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিতে পারেন। এ ব্যাপারে কোনও প্রোটোকলেই কোনও বিধিনিষেধ নেই। সোমবার তা হলে সেই নির্দেশ দেওয়া হয়নি জওয়ানদের, সেটাই প্রশ্ন।’’

পানাঘের আরও বক্তব্য, “১৯৯৬ এবং ২০০৫ সালের চুক্তিতে বলা হয়েছে, দু’পক্ষের সেনাদের মধ্যে কোনও বৈঠকের সময় হাতে অস্ত্র রাখা যাবে না। তবে প্রাণের আশঙ্কা থাকলে জওয়ানরা যে কোনও প্রোটোকলই ভাঙতে পারেন, যদি তাঁদের সে রকম নির্দেশ দেওয়া হয়।’’

গলওয়ান উপত্যকায় রক্তপাতের পরে প্রথম সাংবাদিক বৈঠক করে বৃহস্পতিবীর চিনকে ‘কড়া’ বার্তা দিয়েছেন বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব। তিনি জানান, ৬ জুন দু’দেশের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে বোঝাপড়া থেকে সরে গিয়ে চিন যে ভূখণ্ডের দাবি করছে, তা ধোপে টিঁকবে না। অনুরাগ বলেন, “চিন দ্বিপাক্ষিক ঐকমত্য থেকে সরে গিয়ে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় গালওয়ান উপত্যকার স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত করেছে। তাদের পূর্বপরিকল্পিত পদক্ষেপে হিংসা ছড়িয়েছে এবং সীমান্তের দু’পারে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।’’

গত রাতে দু’দেশের বিদেশমন্ত্রীর ফোনালাপ নিয়ে অনুরাগের বক্তব্য, “বিদেশমন্ত্রী চিনকে জানান, তারা অবিলম্বে সংশোধনী পদক্ষেপ করুক। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা যেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা হয়। একতরফা এমন কিছু যেন না-করা হয়, যাতে স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হয়। গত ৬ জুন যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা মেনে নিয়ে সেনা পিছোনোর বিষয়টি বাস্তবায়িত করা হোক।’’

মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর চিনের বিদেশমন্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে সেনা না সরালে তার প্রভাব দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ‘সমস্ত ক্ষেত্রেই’ পড়বে।

দুই বিদেশমন্ত্রীর ফোনালাপের পর চিনের তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, “নিজের ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় চিনের ক্ষমতাকে ভারতের খাটো করে দেখা উচিত হচ্ছে না।’’

কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, ভারত মূলত দু’টি স্তরে, দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে চিনের মোকাবিলা করতে তৎপর। প্রথম স্তরটিতে অবশ্যই রয়েছে সীমান্তে সেনা বাড়িয়ে লাল ফৌজের মোকাবিলা করে, তাদের ফেরত পাঠিয়ে, মে মাসের আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া। কাজটা যে সহজ নয়, তা অবশ্য ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়টি হল কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে চিনকে চাপে রাখার চেষ্টা করা।

বিজেপি নেতা রাম মাধব আজ বলেছেন, “কৌটিল্য বলেছিলেন, অন্য রাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে ভোঁতা করে দিতে প্রয়োজন জোরদার জাতীয় শক্তি। চিনের সঙ্গে শান্তি চাইছি, কিন্তু সেটা শ্মশানের শান্তি নয়।’’

সূত্রের বক্তব্য, এই ‘জাতীয় শক্তি’ জাগিয়ে তোলার প্রাথমিক ধাপ বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তিতে চিনের সঙ্গে চুক্তি এবং দ্বিপাক্ষিক লেনদেনের বিষয় খতিয়ে দেখা। যেগুলিতে ভারত উপকৃত হচ্ছে না, সেগুলি বাতিল করার কথা ভাবা হতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপে বেজিংকে কতটা কোণঠাসা করা যাবে, তা নিয়ে অবশ্য সংশয় রয়েছে।

পাশাপাশি আমেরিকা, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আর বাড়িয়ে চিন-বিরোধী চতুর্দেশীয় অক্ষকে আরও অর্থপূর্ণ করে তোলারও ভাবনা রয়েছে নয়াদিল্লির। আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত সম্পর্ক বাড়ানো এবং বিশ্বে যেখানে চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, সেখানে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও বেশি বিনিয়োগ করে চিনের ভারতকে ঘিরে ফেলার পাল্টা কৌশল তৈরি করতে চায় নয়াদিল্লি। তিব্বত নিয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়ার চিন্তাভাবনাও করছে সাউথ ব্লক।

ফলে ভারতের হাতে আলোচনা ছাড়া সেই অর্থে অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। যদিও গত দু’দিনের আলোচনায় অগ্রগতি হয়নি এক চুলও। চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ন আজ বলেছেন, ‘‘গালওয়ান উপত্যকায় যে গভীর উদ্বেগজনক সংঘাত ঘটেছে, সে বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে দু’দেশই সহমত। শান্তি সুরক্ষিত রাখা ও উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে আলোচনা চলছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণে।’’

কিন্তু চিন যে ভাবে গালওয়ান উপত্যকাকে নিজেদের বলে দাবি তুলে সুর চড়াচ্ছে, তাতে তারা যে ভারতীয় ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করেছে, সেটা প্রমাণ করাই ভারতের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞদের মতে, চিন তার প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশ— যেমন, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মায়ানমার— সকলের সঙ্গেই সীমান্ত সমস্যা জিইয়ে রাখে। যা তাদের সীমান্ত বিস্তারের দীর্ঘমেয়াদি নীতির অংশ। ফলে লাদাখের মাটিতে পরিকাঠামো গড়ে জাঁকিয়ে বসা চিনা সেনার আশু ফিরে যাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। চিনের এই মনোভাবের নিরিখে আলোচনায় কতটা কাজ হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন