ফ্লোরিডায় নিহত ৫০

সমকামী নাইট ক্লাবে আইএসের সন্ত্রাস

ব্যান্ডের উদ্দাম বাজনা চাপা পড়ে গেল একটানা গুলির শব্দে। তার পর শুধুই রক্ত-কান্না-চিৎকার.. শনিবার রাতে মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে ‘পালস’ নামে সমকামীদের একটি নাইট ক্লাবে এক রাতের জঙ্গি হামলায় নিহত ৫০।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

অরল্যান্ডো শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৬ ০৯:২৫
Share:

আতঙ্কে আত্মীয়রা। অরল্যান্ডো পুলিশের সদর দফতরের বাইরে। ছবি: রয়টার্স

ব্যান্ডের উদ্দাম বাজনা চাপা পড়ে গেল একটানা গুলির শব্দে। তার পর শুধুই রক্ত-কান্না-চিৎকার..

Advertisement

শনিবার রাতে মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে ‘পালস’ নামে সমকামীদের একটি নাইট ক্লাবে এক রাতের জঙ্গি হামলায় নিহত ৫০। আহত পঞ্চাশেরও বেশি। ২০০১-এর ৯/১১-র পরে এত বড় হত্যালীলা দেখেনি আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই ঘটনাকে ‘সন্ত্রাস এবং ঘৃণার প্রকাশ’ বলে মন্তব্য করেছেন। ফ্লোরিডার গভর্নর রিক স্কট ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই জানিয়ে দেন, এটা সন্ত্রাসবাদী হামলা। এর পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিন্টন— সকলেই একে একে জঙ্গি হামলার কড়া নিন্দা করে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়েছেন। একই সঙ্গে জঙ্গিদের কড়া হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন সকলেই।

পুলিশ সূত্রে খবর, আততায়ীর নাম ওমর এস মতিন। মার্কিন নাগরিক নাগরিক হলেও যিনি আদতে আফগান বংশোদ্ভূত। আইএস জঙ্গিদের একটি সংবাদসংস্থাকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, জঙ্গি সংগঠনটির এক জেহাদি সদস্যই এই হামলা চালিয়েছে। আর এটুকুই আমেরিকার শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! অস্বস্তি বাড়িয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যমের খবর, হামলা চালাতে যাওয়ার আগে মতিন পুলিশের ৯১১ নম্বরে ফোন করে নিজেকে আইএস সমর্থক বলে দাবি করেছিল। এত বড় হামলার পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই কী করছিল? আমেরিকায় বসে এত বড় হত্যালীলার পরিকল্পনা তারা জানতে পারেনি কেন? সেটা ঢাকতে মার্কিন গোয়েন্দা কর্তারা যা বলেছেন, তা নিছকই পুলিশি তথ্য। তাঁরা জানাচ্ছেন, ২৯ বছরের ওমর মতিনকে শেষ পর্যন্ত খতম করা গিয়েছে। বিবাহিত মতিনের বাড়ি ফ্লোরিডার পোর্ট সেন্ট লুসি-তে। জঙ্গিদের সঙ্গে তার কোনও যোগ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

Advertisement


ওমর এস মতিন

শুক্রবার রাতে এই অরল্যান্ডো শহরেই একটি অনুষ্ঠানের শেষে বন্দুকবাজের হানায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মার্কিন গায়িকা ক্রিশ্চিয়ানা গ্রিমি। শনিবার হামলা হল সেখান থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে। স্বাভাবিক ভাবে অরল্যান্ডো এখন চরম আতঙ্কে।

মতিনের বাবা মির সিদ্দিকি কিন্তু বলছেন অন্য কথা। ক’দিন আগে এই অরল্যান্ডোতেই আমেরিকার সব চেয়ে বড় বার্ষিক সমকামী উৎসব হয়ে গেল মহা ধুমধামে। মতিনের বাবার মতে, ছেলের হামলার পিছনে ধর্মীয় কোনও কারণ নেই। সমকামীদের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই ছেলে এমন কাজ করে থাকতে পারে।

সপ্তাহের শেষ। রবিবার ভোর পর্যন্ত নাচগান মজায় ডুবে থাকতে অনেকেই ভিড় জমিয়েছিলেন জনপ্রিয় নাইটক্লাবটিতে। ক্লাবে তখন মূল আকর্ষণ নারীবেশে সমকামীদের নাচ। উপচে পড়ছে পানপাত্র, হাসির রোল। গুলি শুরু হয়েছিল ড্রামের তালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। অনেকেই ভেবেছিলেন এ-ও বাজনারই অংশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মতিনের অ্যাসল্ট রাইফেলের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান বহু মানুষ। অ্যাসল্ট রাইফেলের সঙ্গে একটা হ্যান্ডগানও ছিল মতিনের হাতে। পরনে বিস্ফোরক লাগানো আত্মঘাতী জ্যাকেট। নাইটক্লাবে ঢোকার মুখেই নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে এক দফা গুলির লড়াই হয় তার। ভিতরে ঢুকে প্রথমে শূন্যে গুলি চালায় মতিন। তার পর নিশানা করে নীচের ভিড়কে।

নাইটক্লাব কর্তৃপক্ষ দ্রুত ক্লাবে আসা লোকজনকে সতর্ক করেন ফেসবুকে, ‘‘পালস্‌ থেকে বেরিয়ে পালাতে থাকুন।’’ চরম আতঙ্কে ছুটে হামাগুড়ি দিয়ে যে ক’জন পালাতে পেরেছেন, তাঁদেরও বেশির ভাগই বলার অবস্থায় নেই, ভিতরে ঠিক কী ঘটেছে।

যাঁরা পালাতে পারেননি, তাঁদের বন্দি করে রাখে মতিন। এর পর এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে সে। বন্দিদের নিরাপদে বার করে আনতে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বিশাল পুলিশবাহিনী। এর পর চরম সিদ্ধান্ত নেয় পুলিশ। ভোর পাঁচটা নাগাদ ওই আততায়ীকে বিভ্রান্ত করতে দু’টো বিস্ফোরণ ঘটায়। সেই সুযোগেই নাইটক্লাবের ভিতর ঢোকে পুলিশ। এর পর মতিনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় পুলিশের। তাতে এক পুলিশকর্মী আহত হন। অভিযান শেষে সকাল ৬টা নাগাদ পুলিশ ঘোষণা করে, সংঘর্ষে নিহত হয়েছে মতিন। এর পর ৩০ জনকে নিরাপদে উদ্ধার করে আনা হয়।

ওই হামলার ঘটনার পরের কিছু কিছু টুকরো দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদমাধ্যমে। ফোন ক্যামেরায় তোলা কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে, গোটা রাস্তা ছেয়ে গিয়েছে পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুল্যান্সে। নিরাপত্তার কারণে নাইটক্লাবের আশপাশের কয়েকটি ব্লকের রাস্তাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার সকালের দিকে হেলিকপ্টার থেকে তোলা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। তবে ক্লাবের জানলাগুলিতে রাতের হামলার ছাপ তখনও স্পষ্ট।

পুলিশের আশঙ্কা, নাইটক্লাবে ওই হামলাকারী কোনও বিস্ফোরক রেখে থাকতে পারে। ফলে নাইটক্লাবটির আনাচে কানাচে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। তবে ঘটনার সময় ঠিক কত জন সেখানে ছিলেন, তা নিয়ে ধন্দে পুলিশ।

ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে, এমন এক প্রত্যক্ষদর্শী রব রিক জানালেন, নাইটক্লাবটি বন্ধ হওয়ার আগে রাত ২টো নাগাদ বন্দুকবাজ হানা দেয়। সেই সময় ওই ক্লাবে শতাধিক মানুষ ছিলেন বলেই জানিয়েছেন তিনি। কোনও রকমে মাটিতে বসে পড়ে হামাগুড়ি দিয়ে ডিজে বুথের কাছে চলে যেতে পেরেছিলেন রব। তার জেরে এ যাত্রা বেঁচে যান তিনি।

রবের মতোই হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন জন আলামো। ঘটনার সময় ক্লাবেরই একটি ঘরে ছিলেন জন। তাঁর কথায়, ‘‘হঠাৎ দেখি, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘরে ঢুকেছে এক ব্যক্তি। পর পর গুলি চলার শব্দ শুনতে পেলাম। ২০...৩০...৫০। বন্ধ হয়ে গেল গানবাজনা।’’

মাত্র এক জন বন্দুকবাজের হাতে এত জনের মৃত্যু মার্কিন মুলুকে এই প্রথম। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের পয়লা টার্গেট আমেরিকার তাই সবচেয়ে বড় আতঙ্ক, এর পরে আবার কী অপেক্ষা করছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন