দগ্ধ শরীর নয়, ভয় শুধু আইএস-কে

ওদের গলা এখনও কানে বাজে ইয়াসমিনের। যে গলা শুনে সিঁটিয়ে গিয়েছিল বছর সতেরোর ইরাকের ইয়েজিদি কিশোরী। ওর স্থির বিশ্বাস, তাঁবুর বাইরে আইএস জঙ্গিরাই তখন কথাবার্তা বলছিল।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

বার্লিন শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৬ ০২:২৩
Share:

জার্মানির বাড়িতে ইয়াসমিন। (ইনসেটে) ঝলসে যাওয়া হাত। ছবি: এপি।

ওদের গলা এখনও কানে বাজে ইয়াসমিনের। যে গলা শুনে সিঁটিয়ে গিয়েছিল বছর সতেরোর ইরাকের ইয়েজিদি কিশোরী। ওর স্থির বিশ্বাস, তাঁবুর বাইরে আইএস জঙ্গিরাই তখন কথাবার্তা বলছিল।

Advertisement

আবার এসেছে ওরা! আশঙ্কাই যথেষ্ট ছিল। আইএস জঙ্গিদের হাতে তা হলে আবার ধর্ষিত হতে হবে। ভাবতে ভাবতে ইয়াসমিন সিদ্ধান্ত নেয়, আর নয়। এ বার কিছু একটা করতেই হবে। আইএস জঙ্গিরা যেন তাকে দেখে নাক সিঁটকে চলে যায়। তাই নিজেকে সে পেট্রোলে চুবিয়ে ফেলে এক মুহূর্তে। তার পর একটা দেশলাই কাঠি। চুল আর মুখ ঝলসে গেল কিছু ক্ষণের মধ্যে। অসহ্য সেই যন্ত্রণাকেও ভয় পায়নি মেয়েটি।

দগ্ধ শরীরে এখন কান, ঠোঁট আর নাক বলতে কিছু নেই। এই অবস্থায় উত্তর ইরাকের এক শরণার্থী শিবিরে গত বছর ইয়াসমিনকে খুঁজে পান জার্মান চিকিৎসক ইয়ান কিজিলহান। পোড়া শরীর আর ভীত মন নিয়ে মেয়েটি তখনও ভেবে যাচ্ছে আইএস জঙ্গিরা বুঝি আবার আসবে।

Advertisement

ইয়াসমিন এখন ১৮। আইএস-এর হাত থেকে যে ১১০০ ইয়েজিদি মহিলা (বয়স ৪-৫৬) পালিয়ে আসতে সমর্থ হন, ইয়াসমিন তাঁদের এক জন। এখন জার্মানির অজ্ঞাতপরিচয় জায়গায় তাঁদের মানসিক পরিচর্যা দিয়ে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করছেন কিজিলহানের মতো অনেকে। জঙ্গিরা যাতে কোনওমতেই এই সব আস্তানার খোঁজ না পায়, তাই এত গোপনীয়তা।

চিকিৎসকদের মতে, ইয়েজিদি মহিলারা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। রোয়ান্ডা, বসনিয়ায় রোগীদের চিকিৎসা করেছেন কিজিলহান। কিন্তু ইরাকের মহিলাদের অভিজ্ঞতা শুনে তাঁরা শিহরিত। কিজিলহানের কথায়, ‘‘জীবনে এমন দেখিনি। আট বছরের ছোট্ট মেয়ে আপনাকে বলছে, আইএস জঙ্গিরা আট বার কেনাবেচা করেছে তাঁকে। দশ মাসে অন্তত একশো বার ধর্ষণ করেছে। ভাবতে পারেন? কেউ এত নির্দয় কী করে হয়!’’

উত্তর ইরাকের সিঞ্জর এলাকায় ২০১৪-র ৩ অগস্ট হানা দেয় আইএস। ওখানে মূলত ইয়েজিদিদের বাস ছিল। যুবক-কিশোরদের তুলে নিয়ে জঙ্গি হিসেবে দলে নিয়ে নেয় আইএস। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে আপত্তি জানালেই মেরে দেওয়া বয়স্ক ইয়েজিদিদের। কিশোরী-মহিলাদের নিয়ে শুরু হয় কেনাবেচা আর ধর্ষণ।

রাষ্ট্রপুঞ্জের এক বিশেষজ্ঞের দাবি, আইএসের সন্ত্রাসের পরে সিঞ্জরে আর কোনও স্বাধীন ইয়েজিদি নেই। চার লক্ষ মানুষের এই সম্প্রদায়ের সকলেই হয় এলাকাচ্যুত, নয় অপহৃত আর না হলে মৃত। ইয়াসমিনের মতো অনেকের ঠাঁই এখন জার্মানি। ওঁরা আর ফিরতে চান না। বাবা-মা, বোন আর দু’ভাইয়ের সঙ্গে বিদেশেই স্বস্তি খুঁজছেন ইয়াসমিন। বাকিরা ওই দিনগুলো মনে করতে চান না। কিন্তু ইয়াসমিন বলেন, ‘‘আমাদের কথা তো বলতেই হবে। সারা পৃথিবী জানুক আমাদের সঙ্গে কী ঘটেছে।’’ দগ্ধ চামড়ার জন্য ঢিলেঢালা জামা পরেন ইয়াসমিন। নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার তো আর উপায় নেই। তাই বিছানার পাশে রাখা শ্বাস নেওয়ার যন্ত্র। ইয়াসমিন ও সবে বিচলিত নন। স্কুল যেতে চান। ইংরেজি শিখতে চান। আরও ভাল করে জার্মান ভাষাটাও রপ্ত করতে চান। কম্পিউটার সংক্রান্ত কাজ করতে চান ভবিষ্যতে। কিজিলহান জানান, ওঁর অসংখ্য অস্ত্রোপচার বাকি। তাতে দমছেন না ইয়াসমিন। পরিবারের সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে চান তিনি।

জার্মানিতে সম্প্রতি দু’টি হামলার দায় নিয়েছে আইএস। ইয়াসমিনের ভাবনা শুধু সেটুকুই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন