ভোটের সাজ। বিচ্ছেদ সমর্থন করে কেউ দেওয়ালে পোস্টার লাগিয়েছেন, কেউ আবার ব্রিটেনের সঙ্গ না ছাড়ার আর্জি জানিয়ে বিলি করছেন প্রচারপত্র। ছবি: শ্রাবণী বসু এবং এএফপি
রাত পোহালেই ভোট। থুড়ি, গণভোট!
স্কটল্যান্ডে তাই সাজো সাজো রব। স্কটিশ পতাকায় ঢেকে গিয়েছে আকাশ। যে দিকেই তাকানো যায়, ‘ইয়েস’ আর ‘নো’ চিহ্ন চোখে পড়ছে শুধু। স্কটল্যান্ডের বাসিন্দারা বেশ কিছু দিন ধরে এই দুই ভাগেই বিভক্ত যে। কেউ বলছেন ‘ইয়েস’, স্বাধীন স্কটল্যান্ডের পক্ষেই রায় দেবেন তাঁরা। আবার কেউ বলছেন ‘নো’। কোনও মতেই ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষপাতী নন তাঁরা।
তবে এই দ্বন্দ্ব শুধু কি স্কটল্যান্ডের একার? বোধহয় না। গ্লাসগো, এডিনবরার মতো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে গোটা ব্রিটেনও। কারণ, আর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা। বুক রীতিমতো ধুকপুক করছে ব্রিটেনের। শুক্রবারই জানা যাবে গণভোটের ফল। জানা যাবে, স্কটল্যান্ড আদৌ কি আর ব্রিটেনে থাকবে? নাকি হ্যাঁ-ভোটারদের দৌলতে তিনশো বছরের পুরনো সম্পর্ক ভেঙে করে বেরিয়ে আসবে ব্রিটিশ পরিবার থেকে।
কাল সকাল সাতটায় ভোট শুরু। চলবে রাত দশটা পর্যন্ত। ভোটগ্রহণ শেষ হলেই শুরু হবে গণনা। কালকের ভোট যাতে সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়, তার জন্য নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু ব্যবস্থাও। মোতায়েন করা হচ্ছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার স্বেচ্ছাসেবী। বাসিন্দাদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন তাঁরা। স্কটিশ হাইল্যান্ডসের মতো দুর্গম এলাকায় ভোট শেষ হলে নৌকো করে ব্যালট বাক্স পৌঁছে দেওয়া হবে গণনা কেন্দ্রে। স্কটিশ পুলিশ অবশ্য জানাচ্ছে, ভোট ঘিরে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা নেই। তাই অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী মোতায়েনের কথা ভাবা হচ্ছে না।
তবে স্কটিশ পুলিশ মুখে যা-ই দাবি করুক, আজ কিন্তু টানটান উত্তেজনা ছিল স্কটল্যান্ড জুড়ে। হ্যাঁ আর না দু’পক্ষই দফায় দফায় মিছিল করেছে সারা দিন। রাজধানী এডিনবরার প্রিন্সেস স্ট্রিটে যেমন সকাল থেকেই চলছে গান-বাজনা। দোকান-বাজার-রেস্তোরাঁ-পাব সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু একটাই গণভোট। কিন্তু না-পন্থীদের দাবি, প্রতিপক্ষের কাছে মার খেতে হয়েছে তাঁদের। এক না-পন্থী তো বলেই দিলেন, “আমার গাড়ির জানলার কাচ গুঁড়িয়ে দিয়েছে ওরা। এই লড়াইটা আসলে ভীষণ ভাবে বিভাজন তৈরি করছে। দেশের মধ্যে, পরিবারের মধ্যেও। একই পরিবারের সদস্যরা গণভোট নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। কোনও পরিবারে হয়তো বাবা-মা ব্রিটেনেই থাকতে চান, কিন্তু সন্তানরা চাইছে পৃথক স্কটল্যান্ডের অস্তিত্ব।”
উল্টো দিকে, হ্যাঁ-পন্থীদের দাবি, নব্বই শতাংশ ভোট তাঁদের পক্ষেই যাবে। প্রতিপক্ষকে তেমন পাত্তাই দিতে চান না তাঁরা। রানি থেকে রোওলিং। ক্যামেরন থেকে ব্রাউন। তাবড় তাবড় ব্রিটেনবাসী যতই না-ভোটের পক্ষে সওয়াল করুন না কেন, আজ সারাটা দিন ভোট প্রচারে হ্যাঁ-পন্থী মুখই বেশি দেখা গিয়েছে।
স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা তো বটেই, কালকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটা বড় নামের কাছেও। ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ যেমন শুক্রবার থাকবেন স্কটল্যান্ডের বালমোরালের রাজবাড়িতে। সকাল থেকেই ভোটের ফলের দিকে নজর থাকবে তাঁর। সংযুক্ত ব্রিটেনের রানি হিসেবে এত দিন পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। কিন্তু এর পর কী হবে? একটি সূত্রের মতে, স্কটল্যান্ড ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে আসলেও মাথার উপর রানির ছত্রচ্ছায়া থাকবেই। আলাদা করে স্কটল্যান্ডের রানি হিসেবেও পরিচিতি পাবেন তিনিই। আরেকটি নামও না করলেই নয়। ডেভিড ক্যামেরন। এই ক’দিনে বহু বার স্কটল্যান্ডবাসীর কাছে না-ভোটের পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি। এখন যদি ফল বিপক্ষে যায়, তবে তাঁর দায় কি এড়াতে পারবেন ক্যামেরন? প্রশ্নটা গোটা ব্রিটেনেই ঘুরপাক খাচ্ছে গত কয়েক দিন ধরে। অনেকেরই আশঙ্কা, গণভোটের ফলের দায় মাথায় নিয়ে শেষে না প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় ক্যামেরনকে।
গণভোটের ফলের উপর নির্ভর করবে আরও অনেক সমীকরণ। যেমন লেবার পার্টির ভাগ্য। ৫৯ জন স্কটিশ মন্ত্রীর মধ্যে ৪০ জন লেবার পার্টির। স্কটল্যান্ড আলাদা হয়ে গেলে তার ফল দলের উপরও ভাল মতোই পড়বে বলে মনে করছেন অনেকে।
সমস্যা হতে পারে রাষ্ট্রপুঞ্জেও। অবিভক্ত ব্রিটেনের অংশ হিসেবে এত দিন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ ভোগ করে এসেছে ব্রিটেন। স্কটল্যান্ড ব্রিটেন ছেড়ে গেলে ফের নতুন করে স্থায়ী সদস্যের জন্য ঝক্কি সামলাতে হতে পারে ব্রিটেনকে।
আরও একটা ভাবনা বড্ড বেশি ভাবাচ্ছে ব্রিটেনবাসীকে। স্কটল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ব্রিটেনের উপর ঝুলতে পারে আর্থিক মন্দার খাঁড়া। ১৯২৯ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’-এর সেই দিনগুলো ফের ফিরে আসতে পারে বলেও আশঙ্কিত অনেকে। এই অবস্থায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন আজ ফের না-ভোটের পক্ষে সওয়াল করেছেন। একটি আবেগঘন বক্তৃতায় এই গর্বিত স্কটিশ বলেছেন, “এটা আমাদের স্কটল্যান্ড। এই স্কটল্যান্ড ‘ইয়েস ক্যাম্পেনের’ হতে পারে না। এটা সকলের দেশ। কাল আমাদের পেনশন, পাসপোর্ট সব ব্রিটেনেই থাকুক। আসুন একসঙ্গে থাকি।”
না-ভোটের পক্ষে সওয়াল করেছে অন্য দেশের রাজনীতিকরাও। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন না-ভোটেরই পক্ষে। আসলে ওবামা প্রশাসনও চায়, ব্রিটেনের সঙ্গেই থাকুক স্কটল্যান্ড। ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও বিশ্বাস করেন, ভাঙতে পারে না ব্রিটেন।
এত সব কিছুর মধ্যেও বাকি থেকে গিয়েছে আরও একটা অঙ্কের হিসেব। ভোটের ফলে কতটা প্রভাব ফেলতে চলেছেন প্রবাসী ভারতীয়রা? উত্তরটা জানতে অপেক্ষা আর মাত্র ৪৮ ঘণ্টার।