লেখক নেদারল্যান্ডসে কর্মরত
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যোগাযোগ এখন সকলের হাতের মুঠোয়। খবরের আদান-প্রদান হচ্ছে মুহূর্তে। সুদূর নেদারল্যান্ডসে বসেও তাই ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের উত্তাপ আঁচ করা যাচ্ছে বেশ ভাল মতোই। কুড়ি বছরেরও বেশি ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার চারটে দেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এ সব জায়গায় ভোট-পাখির আনাগোনাটা আমাদের দেশের তুলনায় অনেকটাই নিঃশব্দে। আমেরিকা বা কানাডায় নির্বাচনের পারদ যদি-বা একটুখানি চড়ে, ইউরোপীয় দেশগুলোর ভোটপর্ব মিটে যায় অনেকটাই চুপিসারে। ব্রেক্সিট অবশ্য ব্যতিক্রমী!
আট বছর এ দেশে রয়েছি। এই প্রথম অফিসে লাঞ্চের আড্ডায় ডাচদের প্রশ্ন শুনে ঠাওর হচ্ছে, এ দেশের লোকজনও অল্পবিস্তর জেনে গিয়েছে যে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে ভোট-পুজো আসন্ন। এখানকার অনেক স্থানীয়ই ভারতের ভোট ব্যবস্থা নিয়ে আমাকে নানা প্রশ্ন করছেন। তবে তাঁদের কৌতুহল অনেকটাই পুজোর বাজনা আর নৈবেদ্যের দিকে। রাজনৈতিক ফলাফলের থেকেও তাঁরা জানতে বেশি আগ্রহী— ভারতে ভোটের প্রচার নিয়ে এত মাতামাতি হয় কেন, বা এত লোকের ভোট দেওয়াটা ঠিকঠাক ভাবে হয় কি না।
১ কোটি ৭০ লক্ষ লোকের দেশ নেদারল্যান্ডসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র সেই ১৮১৫ সাল থেকে। ৭৫ আসনের সেনেট বা উচ্চকক্ষ আর ১৫০ আসনের নিম্নকক্ষ নিয়ে গঠিত হয়েছে ডাচ পার্লামেন্ট। যে ১২টা প্রদেশ নিয়ে নেদারল্যান্ডস তৈরি হয়েছে, সেই প্রাদেশিক কাউন্সিলগুলোর আর সংসদের নিম্ন কক্ষের ভোটাধিকার শুধু ডাচ নাগরিকদের জন্যই সীমাবদ্ধ। একেবারে আঞ্চলিক স্তরে প্রায় ৪০০টা পৌরসভা এবং ২৭টা জল বিভাগ বা জল বোর্ড-এর ভোটে ডাচ নাগরিকদের সাথে আমাদের মতো স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সাড়ে চার লক্ষ বিদেশিরাও ভোট দিতে পারেন। যে হেতু এই দেশটার ১৭% স্থলভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নীচে, তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাম-শহরে পরিশ্রুত পানীয় জলের সরবরাহে এই নির্বাচিত জল বোর্ডগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই ডিজিটাল যুগে ডাচ ভোটারদের জন্য নানাবিধ অনলাইন সাহায্যও রয়েছে। কাকে ভোট দেবেন, তা সরাসরি না বললেও এই সব সাইট বিভিন্ন ইস্যুতে কোন দলের কী অবস্থান জানিয়ে দেয় এবং সহজ প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আপনার মতাদর্শের ভিত্তিতে কী অবস্থান হওয়া উচিত, তা-ও ভাবতে সাহায্য করে। এ ধরনের কিছু ওয়েবসাইট আবার খুব ‘পারসোনালাইজ়ড’-ও হয়। যেমন সমকামী ভোটার, নবীন ভোটার, নারীবাদী ভোটার, এমনকি মাদকসেবী ভোটারদের জন্যও আলাদা আলাদা একাধিক ওয়েবসাইট রয়েছে।
দিন কয়েক আগে, ২০ মার্চ, প্রাদেশিক কাউন্সিল আর জল বোর্ডগুলোর ভোট হয়ে গেল। তার দিন কয়েক আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি, ভোট একেবারে দোরগোড়ায়। সপ্তাহান্তে বাজারে হাসিমুখে লোকজন লিফলেট বিলি করছে দেখে বুঝলাম, ভোটের বাদ্যি বেজেছে। তত দিনে অবশ্য বাড়িতে চলে এসেছে বিভিন্ন দলের প্রার্থী-তালিকা। অফিস-ফেরতা সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দুরত্বে প্রাইমারি স্কুলে ভোট দিতে গেলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি প্রায় ফাঁকা ভোটকেন্দ্র সামলাচ্ছেন চার ষাটোর্ধ্ব বুড়ো-বুড়ি। হাসি মুখে
আমার হাতে ব্যালট পেপার ধরিয়ে দিলেন। আমিও জায়গা মতো লাল পেন্সিলের দাগ দিয়ে কাগজটা মুড়ে বাক্সে ফেলে দিলাম। সব মিলিয়ে লাগল মিনিট দেড়েক।
প্রাদেশিক ভোটে জাতীয়তাবাদী দলের উত্থান চোখে পড়ার মতো আর পরিবেশপন্থী দলের জয়ের ধারাও অব্যাহত। অন্য দিকে ক্ষমতায় যারা রয়েছে, সেই কনজ়ারভেটিভ লিবারাল কোয়ালিশনের আসন হালে অনেকটাই কমেছে। গত কয়েক বছর ভোটের সময়ে অতি দক্ষিণপন্থী দলের অনুপ্রেরণায় কিছু অনভিপ্রেত কাদা ছোড়াছুড়ি চোখে পড়লেও সব প্রার্থীরই নূন্যতম পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি আছে আর মতাদর্শগত বিরোধ থাকলেও সবাই মিলেমিশে সংসদে কাজ করতে পারে। দেশের প্রধানমন্ত্রী সাইকেল চালিয়ে সংসদে আসেন এবং নিজের হাত থেকে কফির কাপ পড়ে গেলে সাফাইকর্মীর হাত থেকে ঝাড়ু নিয়ে নিজেই তা পরিষ্কার করে দেন!