শেষ পর্যন্ত মানুষের উপরে ব্যবহারের সবুজ সঙ্কেত পেল পৃথিবীর প্রথম ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক টিকা। শুক্রবার ইউরোপের ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রক সংস্থা (ইউরোপিয়ান ড্রাগ রেগুলেটরস)-এর পক্ষ থেকে আফ্রিকায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত শিশুদের উপরে এই প্রতিষেধক ব্যবহারের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
তবে আফ্রিকায় শিশুদের উপরে প্রয়োগের আগে এটি পরীক্ষা করে দেখবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (হু)। এ বছরের নভেম্বরে হু সুপারিশ করলে তবেই আগামি বছরগুলোয় এটি ধীরে ধীরে আফ্রিকার শিশুদের উপরে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে এই ‘মসকুইরিক্স’ (আরটিএস,এস ভ্যাকসিন) প্রতিষেধকটি তৈরি করেছে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন কোম্পানি। সংস্থার এক শীর্ষকর্তা জানিয়েছেন, ‘‘ইউরোপিয়ান ড্রাগ রেগুলেটরস-এর অনুমতি পাওয়াটা আমাদের কাছে স্বপ্নপূরণের মতো। ৩০ বছর ধরে আমরা ম্যালেরিয়ার টিকা নিয়ে গবেষণা করছি। অবশেষে স্বীকৃতি মিলল।’’ প্রতিষেধকটির দাম এখনও ঘোষণা করেনি নির্মাতা সংস্থা।
সারা পৃথিবীতে বছরে ম্যালেরিয়ায় ৫ লক্ষ ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান। এর মধ্যে অধিকাংশই আফ্রিকার পাঁচ বছরের নীচে থাকা শিশু। নির্মাতাদের দাবি, এই শিশুদের ম্যালেরিয়া থেকে বাঁচাতেই মসকুইরিক্স প্রতিষেধকটি বিশেষ ভাবে তৈরি হয়েছে। ৫ থেকে ১৭ মাসের শিশুদের উপরে এই প্রতিষেধক সবথেকে বেশি কার্যকরী। শুধু তাই নয়, পরীক্ষামূলক ভাবে এই মসকুইরিক্সের তিনটি ডোজে’র প্রায় দু’বছর পরে দেওয়া হয় ‘বুস্টার’ ডোজ। তখন দেখা যায়, এই নিয়মমাফিক ডোজের পরে চার বছরে আফ্রিকায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। কিন্তু, বুস্টার ডোজ ছাড়া ম্যালেরিয়া রোধে মসকুইরিক্সের ক্ষমতা কতটা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। তা ছাড়া ১৭ মাসের বেশি বয়সের শিশুর ক্ষেত্রে এই প্রতিষেধক কোনও কাজও করে না।
সাধারণত জন্মের ছ’সপ্তাহ থেকে শিশুদের বিভিন্ন প্রতিষেধক টিকা দেওয়া শুরু হয়। ম্যালেরিয়ার টিকাও ওই সময় থেকে দেওয়া যায় কি না, তার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ৫ থেকে ১৭ মাসের শিশুদের ক্ষেত্রেই একমাত্র প্রযোজ্য ওই টিকা। আলাদা করে যা দিতে হবে। এই টিকার দাম কত হবে তা ঠিক করতে এ মাসেই বৈঠক ডেকেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে এই মুহূর্তে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে প্রতিষেধক মসকুইরিক্সের চেয়ে মশারির উপরেই আস্থা রাখছেন অধিকাংশ ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ। এ দেশের ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞেরাও আফ্রিকায় শিশুদের উপরে এই টিকা কেমন কাজ করে, তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কারণ ভারতীয় উপমহাদেশেও ম্যালেরিয়া জনস্বাস্থ্যের একটি বড় সমস্যা।
ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ কলকতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিতাভ নন্দী বলেন, ‘‘পরীক্ষাগারে কিংবা পরীক্ষামূলক ভাবে কোনও টিকার সাফল্য আর কার্যক্ষেত্রে সেটির প্রয়োগের মধ্যে অনেক পাথর্ক্য। প্রকৃত ভাবে জনস্বাস্থ্য প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে গেলে আরও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে একেবারে অব্যর্থ হয়ে উঠতে আরও কিছু সময় দরকার।’’
কিন্তু শুধু টিকাতেই ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রমণকে রোখা যাবে না বলে মন্তব্য অমিতাভবাবুর। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘যে কোনও সংক্রমণ ঠেকাতে টিকাকরণ অন্যতম একটা বড় হাতিয়ার। পাশাপাশি মশা নিধন, সঠিক ভাবে রোগ নির্ণয় এবং সঠিক চিকিৎসাও জরুরি। তিন পদ্ধতি পাশাপাশি চললে ম্যালেরিয়ার মতো সংক্রমণকে সামাল দেওয়া যাবে। নচেৎ নয়।’’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এই টিকায় সব থেকে সুবিধা হবে পর্যটকদের। যাঁরা ম্যালেরিয়াহীন দেশ থেকে কোনও ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় চলে আসেন, তাঁদের উপরে সংক্রমণ সব সময়েই জটিল হয়। তাই কোনও ব্যক্তি এর পর থেকে ম্যালরিয়াপ্রবণ এলাকায় গেলে আগে থেকে টিকা নিলেই তিনি ম্যালেরিয়ার আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারবেন।
ম্যালেরিয়ার এই টিকা বাজারে আসার পরে তার দাম কত হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ‘‘একবার ম্যালেরিয়ার টিকা বাজারে এলে দাম কোনও সমস্যা হবে না। কারণ, এড্স, এনসেফ্যালাইটিস, পোলিও-র মতো টিকাকরণ কর্মসূচি চলে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা ইউনিসেফের তত্ত্বাবধানে। ভারতের মতো দেশগুলিতে তারাই বিনা পয়সায় টিকা সরবরাহ করে। এ ক্ষেত্রেও তাই হবে।’’