রোমের রাস্তায় বাংলায় বন্দনা মমতার

মাদার টেরিজার সন্ত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু দিনের একটি প্রাচীন প্রবাদকে ভুল প্রমাণিত করে দিলেন। লাতিন প্রবচনটার কথা আমরা সবাই জানি। যার অর্থ হল, যদি রোমে থাকতে হয়, রোমানদের মতো করে থাকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রোমে এলেন, দেখলেন। এবং দেখালেন, তিনি তাঁর মতো।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

ভ্যাটিকান সিটি শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:৫৬
Share:

ভ্যাটিকানের রাস্তায় মুখ্যমন্ত্রী। ছবি পিটিআই।

মাদার টেরিজার সন্ত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার পাশাপাশি আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহু দিনের একটি প্রাচীন প্রবাদকে ভুল প্রমাণিত করে দিলেন। লাতিন প্রবচনটার কথা আমরা সবাই জানি। যার অর্থ হল, যদি রোমে থাকতে হয়, রোমানদের মতো করে থাকতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রোমে এলেন, দেখলেন। এবং দেখালেন, তিনি তাঁর মতো।

Advertisement

সন্ত হয়ে ওঠার খ্রিস্টীয় ধর্মপদ্ধতি যেমন বর্ণাঢ্য তেমনই প্রলম্বিত। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টার এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। প্রখর সূর্যের তেজে চাঁদিফাটা এই গরমে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তাঁদের স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চলছে লাগাতার মন্ত্রোচ্চারণ। এ সবের মধ্যে চিত্তাকর্ষক ব্যক্তিত্ব কিন্তু মমতাই।

তিনি ভিআইপি মঞ্চে গিয়ে বসবেন না, সেটা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। গতকাল রাতে ভ্যাটিকান সিটি-র নিরাপত্তা অফিসার অনুরোধ করেছিলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বিশেষ আসনে বসার জন্য। তাতেও রাজি হননি মমতা। বলেছিলেন, ‘‘আমি এখানে এসেছি মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র আমন্ত্রণে। তাই যেখানে মিশনের প্রতিনিধি, সন্ন্যাসিনী এবং বাংলার মানুষের প্রতিনিধিরা বসবেন সেখানেই আমি থাকব। তা যদি পিছনে হয়, হোক না! ক্ষতি কী!’’

Advertisement

বাংলার কাছে অবশ্য এই মমতা অপরিচিতা নন। বরং এটাই তাঁর দস্তুর। ভিআইপি আসন পরিত্যাগ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়াই তাঁর বৈশিষ্ট্য। সংসদেও তিনি অনেক সময়ই বসতেন পিছনের সারিতে। পোপের রাজত্বেও সেই ট্র্যাডিশন চলল।

স্বাতন্ত্র্যের ছবি দেখা গিয়েছিল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই। সকাল ৯টায় হোটেল থেকে বৈতালিকের মতো করে গান গাইতে গাইতে নিজের প্রতিনিধিদল নিয়ে হেঁটে এসে পৌঁছন সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে, সেই পদযাত্রায় শামিল ছিলেন সাংবাদিকরাও। গান শুরু হয় খোলা গলায় ‘আগুনের পরশমণি’ দিয়ে, যা নাকি ছিল মাদারের বড় প্রিয়। এর পর ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’, ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে’— চলতে থাকে গান।

অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে পিছনে এসে বসলে, পোপের নির্দেশে সিস্টার প্রেমা এসে বসেন মমতার কাছে। নীরবে হেসে হাত ধরে মঞ্চের সামনে নিজের পাশে এনে তাঁকে বসান সিস্টার প্রেমা। সিস্টার প্রেমা এখন মাদার হাউসের প্রধান। তিনি এই অনুষ্ঠানের ভারপ্রাপ্তও বটে। তাঁকে দিয়ে মমতাকে একদম পিছন থেকে সামনে নিয়ে এসে পোপ আজ এক বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করলেন।

অনুষ্ঠান শেষে এই প্রবল দাবদাহে যখন এক হুইল চেয়ারবন্দি ইতালীয় মহিলা অসুস্থ হয়ে পড়েন, নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত বের হতে থাকে, তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে দেখা গেল প্রধান শুশ্রূষাকারীর ভূমিকায়। তিনি নিজে অবশ্য কোনও ছাতা নেননি। বসেছিলেন খোলা আকাশের তলাতেই।

আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরনে ছিল তাঁর প্রিয় নীল পাড় সাদা শাড়ি, যে পোশাকে তাঁকে দেখতে অভ্যস্ত বাংলার মানুষ। সঙ্গী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পরেছিলেন পাজামার সঙ্গে নীল পাঞ্জাবি। নীল পাঞ্জাবি কালো ধুতি পরেছিলেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। যাঁর প্রধান কাজ ছিল অনুষ্ঠানের প্রার্থনামন্ত্রের মর্ম অন্যদের ব্যাখ্যা করে বোঝানো। নীল পাড় সাদা খোলের শাড়িই মাদার টেরিজা আর তাঁর প্রতিষ্ঠানের এক পরিচিত প্রতীক। আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে মাদারের সন্তায়ন অনুষ্ঠানে মমতার শাড়ি-ভাষা তাই এক মাস্টারস্ট্রোক, এমনটা মনে করছেন অভ্যাগতদের অনেকেই!

পোপ ফ্রান্সিসের পক্ষ থেকে আজ উপস্থিত জনতার হাতে তুলে দেওয়া হয় বাইবেলের উদ্ধৃতি সম্বলিত একটি টেক্সট, যা আজ প্রার্থনামন্ত্রও বটে। তাতে অন্য সব ভাষার পাশাপাশি রয়েছে বাংলাও। মমতা আজ বলেন, ‘‘মাদারের সন্ত হওয়ার ঘটনায় আমি রোমাঞ্চিত। খুশি তো বটেই। মা বাংলার মানুষ। তাই বাংলার গর্ব এখানে প্রতিষ্ঠিত হল।’’ প্রতিনিধিদলের বুকে একটি ব্যাজ তিনি দিয়েছেন যেখানে লেখা— ‘উইথ হোমেজ ফ্রম দ্য সিটি অব মাদার, ক্যালকাটা’। ব্যাজের উপরে লেখা, ‘টিম বাংলা’।

সত্যিই বাংলা আর কলকাতার মানুষের উপস্থিতি ছিল দেখবার মতো। আর্চবিশপ টমাস ডিসুজা হলেন পশ্চিমবঙ্গের ক্যাথলিক ধর্মগুরু। তাঁর নেতৃত্বে এসেছেন প্রায় দেড়শো জন ‘পিলগ্রিম’। এসেছেন মাদারের নানান হোম থেকে ব্রাদার এবং সিস্টাররা। আর গোটা দুনিয়া থেকেও শতাধিক ব্রাদার-সিস্টার। অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ভারতীয় রেস্তোরাঁ কোহিনূর। সেখানেই মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যে আর্চবিশপ আয়োজন করেছিলেন এক বিশেষ মধ্যাহ্নভোজের। সেখানেই মেনুতে ছিল বাঙালি ও অন্য ভারতীয় খাবার। এর সঙ্গে ছিল পাস্তা-পিৎজাও।

কলকাতা থেকেই মিশনারিজ অব চ্যারিটি সংস্থার প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন অন্তত কয়েকশো মানুষ। কলকাতা, বারুইপুর, দার্জিলিং, মেদিনীপুর থেকে এ দিন বিশপেরা যেমন এসেছিলেন, তেমনই আবার প্রোটেস্টান্ট চার্চের অশোক বিশ্বাসকেও প্রতিনিধিদলে রেখেছেন কলকাতার আর্চবিশপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন