ঘটনাস্থলে ভাঙা ক্রেন। মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে। ছবি: পিটিআই।
ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা। আশি হাজারেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছেন শুক্রবারের প্রার্থনার জন্য। হঠাৎই মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদে ভেঙে পড়ল একটি ক্রেন। ১০৭ জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়া এই দুর্ঘটনার জন্য হাওয়ার গতিকে দুষছে সৌদি আরব। হতাহতের তালিকায় রয়েছেন দুই মহিলা-সহ ২১ জন ভারতীয়ও। এই ঘটনার কোনও প্রভাব হজ যাত্রায় পড়বে না বলে জানিয়েছেন মসজিদ কর্তৃপক্ষ।
গ্র্যান্ড মসজিদে কিছু দিন ধরেই সংস্কার কাজ চলছে। মসজিদের এলাকা ৪০ হাজার বর্গমিটার বাড়াতে চায় সৌদি আরব। ২০০৭ সালে এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন প্রয়াত সৌদি রাজা আবদুল্লা বিন আব্দুল আজিজ। মসজিদের চার দিকে এখন ১৫টি বড় বড় ক্রেন। স্থানীয় সময় শুক্রবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সেগুলিরই একটি ভেঙে পড়ে। ক্রেনের আঘাতে ভেঙে পড়ে মসজিদের ছাদের একটি অংশও। চার দিকে ছিটকে পড়ে দেহ। আতঙ্কে দৌড়তে শুরু করেন মানুষ। তখন পদপিষ্ট হয়েও অনেকে মারা গিয়েছেন বলে দাবি সৌদি প্রশাসনের। মসজিদের সাদা মেঝেতে রক্তের ছাপ, মৃতদেহের স্তূপের বহু ছবিই ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে।
আহতদের জন্য রক্ত চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন স্থানীয়রা। আবেদনে সাড়া দিয়ে গত কাল রাত থেকেই হাসপাতালে হাসপাতালে দেখা গিয়েছে ভিড়। কোথাও কোথাও রক্ত দিতে সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন মানুষ।
দুর্ঘটনায় মৃত দুই ভারতীয়ের পরিচয় জানিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। তাঁরা হলেন পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের বাসিন্দা মনিজা আহমেদ ও কেরলের মাইমুন। ইসমাইল ও তাঁর স্ত্রী মাইমুন তিন দিন আগেই হজ করতে মক্কায় এসেছিলেন। আহত হয়ে হাসপাতালে রয়েছেন মাইমুন। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ জানান, ১৯ জন ভারতীয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন হজ কমিটির। পরিস্থিতির উপর নজর রাখতে জেড্ডায় ভারতীয় কনস্যুলেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। চালু করা হয়েছে তিনটি হেল্পলাইন। আহতদের মধ্যে তাদের ৪৭ জন নাগরিক রয়েছেন বলে জানিয়েছে পাক সরকার। এঁদের মধ্যে সাত জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
কেন ভেঙে পড়ল ক্রেন? এখনও নির্দিষ্ট ভাবে কিছু জানায়নি সৌদি আরব। তবে প্রাথমিক তদন্তের
পর মসজিদ কর্তৃপক্ষ মনে করছেন, খারাপ আবহাওয়া, প্রবল ঝড়-বৃষ্টির ফলেই এই গোলযোগ। একই কথা বলেছেন মসজিদে কর্মরত আব্দেল আজিজ নাকুর। সে সময়ে ওখানেই হাজির ছিলেন নাকুর। বিশাল ক্রেনটি ভেঙে পড়তেও দেখেছেন তিনি। দুর্ঘটনার কিছু আগেই টুইটারে সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছিল, ‘‘প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সংস্কারের কাজে সমস্যা হচ্ছে।’’ আর তার পর পরই উল্টে পড়ে ওই বিশাল ক্রেনটি। মক্কার গর্ভনর যুবরাজ খালেদ অল-ফয়জল এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
হজ যাত্রার সময়ে দুর্ঘটনা নতুন নয়। ১৯৯০, ২০০৪, ২০০৬ সালে হজ যাত্রার সময়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিলেন বহু মানুষ। তবে হজ যাত্রাকে নিরাপদ করতে পরিকাঠামো, পরিবহণ-সহ নানা ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগও করেছে সৌদি আরব। গ্র্যান্ড মসজিদের চার দিকে এখন ঝাঁ চকচকে শপিং মল ও বিশাল বিশাল বাড়ি। তার মধ্যেই রয়েছে তৃতীয় উচ্চতম বাড়ির খেতাব পাওয়া এক ক্লক টাওয়ার। পবিত্র এই তীর্থস্থানের দায়িত্ব কাঁধে থাকায় ইসলামি জগতে বিশেষ মর্যাদা রয়েছে সৌদি রাজ পরিবারের। মসজিদ সংস্কারের কাজে মূল ভূমিকা নিয়েছে বিনলাদিন গোষ্ঠী। সৌদি রাজ পরিবারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ এই গোষ্ঠী সে দেশে অধিকাংশ বড় বড় নির্মাণকাজ করে। কিন্তু ক্রেন দুর্ঘটনার পরে গ্র্যান্ড মসজিদের নিরাপত্তা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
ঘটনার পরে সরাসরি মসজিদ কর্তৃপক্ষের দিকে আঙুল তুলেছে সৌদি আরবেরই কোনও কোনও শিবির। মক্কার ইসলামিক হেরি়টেজ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ইরফান অল-আলওয়াই বলেছেন, ‘‘ওই স্থানের ঐতিহ্য এবং ভক্তদের সুরক্ষা নিয়ে ওঁরা (মসজিদ কর্তৃপক্ষ) আদৌ চিন্তিত নন।’’
কিছু দিন পরেই হজ উপলক্ষে প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ ভিড় করবেন মক্কায়। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এই দুর্ঘটনার কোনও ছাপ কি আদৌ পড়বে হজে? মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, কয়েক দিনের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাটি সারিয়ে তুলবেন।
এই সংক্রান্ত আরও খবর: