স্নায়ুর যুদ্ধে শরিফের মধুর অস্ত্র তেহমিনা

কার্তিয়ে কিংবা রে ব্যান-এর ফ্রেমের পিছনে উজ্জ্বল চোখ। ঠোঁটে বোদলেয়ার-মালার্মের পদ্য। নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। শানিত অথচ মার্জিত শব্দচয়নে বিপক্ষকে মুহূর্তেই বিভ্রান্ত করে দেওয়ার ক্ষমতা।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:০১
Share:

তেহমিনা জানজুয়া

কার্তিয়ে কিংবা রে ব্যান-এর ফ্রেমের পিছনে উজ্জ্বল চোখ। ঠোঁটে বোদলেয়ার-মালার্মের পদ্য। নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরাসিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। শানিত অথচ মার্জিত শব্দচয়নে বিপক্ষকে মুহূর্তেই বিভ্রান্ত করে দেওয়ার ক্ষমতা।

Advertisement

এই সব কিছু মিলিয়েই তেহমিনা জানজুয়া। পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে প্রথম মহিলা বিদেশসচিব হিসেবে আগামী ১ মার্চ দায়িত্ব নিচ্ছেন যিনি। কাশ্মীরকে ফের আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসতে উদ্‌গ্রীব নওয়াজ শরিফের ইস্কাবনের বিবি হতে চলেছেন পাক বিদেশ মন্ত্রকের প্রাক্তন এই মুখপাত্র। পাকিস্তানের নতুন আমদানি করা এই ‘মধুর কূটনীতি’ কী ভাবে সামলাবেন ভারতীয় বিদেশসচিব এস জয়শঙ্কর? এই নিয়েই জোর আলোচনা সাউথ ব্লকে। যে আলোচনায় কৌশলের সঙ্গে মিশে রয়েছে কিছুটা কৌতূহলও।

বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘পাকিস্তানের পুরুষ-প্রধান প্রশাসনে এর আগে মহিলা বিদেশমন্ত্রী হিসেবে আমরা হিনা রব্বানি খারকে দেখেছি। ভারত সফরের সময় তাঁর ফ্যাশন স্টেটমেন্ট একাধিক বার সংবাদমাধ্যমের আলোচ্য বিষয় হয়েছে। কিন্তু তিনি কার্যত ছিলেন পাক সেনার মুখপাত্র মাত্র। নতুন কোনও পদক্ষেপ তিনি করতে পারেননি, বারবার বৈঠকে বসেও।’’ যদিও প্রশ্ন থাকে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে নতুন মাইলফলক সাম্প্রতিক অতীতে কোন পাক বিদেশমন্ত্রীই বা তৈরি করতে পেরেছেন? কিন্তু কূটনৈতিক শিবির মনে করে, দু’দেশের সম্পর্কে সাময়িক হলেও একটা মধুর আবহ দিয়েছিল ২০১১ সালে হিনা রব্বানির ভারত সফর। নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে তাঁর সঙ্গে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর বৈঠকের পর ছবি তোলার জন্য ভারতীয় মন্ত্রী-আমলাদের লাইন ছিল দীর্ঘ। কৃষ্ণর সঙ্গে হিনার দীর্ঘ ও উষ্ণ করমর্দন সাময়িক হলেও তৈরি করেছিল দ্বিপাক্ষিক শুভেচ্ছার ফ্রেম। এবং এই উষ্ণতায় কিছুটা ছদ্ম অস্বস্তি দেখিয়ে স্বয়ং হিনা বলেছিলেন, ‘‘আমার জায়গায় কোনও পুরুষ মন্ত্রী এলে হয়তো এতটা নজরের মধ্যে পড়তেন না। আমার নানা রকম অকাজের জিনিস নিয়েও এত আলোচনা হচ্ছে! এ নিয়ে আমার ক্ষমা চাইবার কোনও কারণ নেই। আমি এমনই থাকব।’’ ‘অকাজের জিনিস’ বলতে হিনা যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তা হল— তাঁর দশ হাজার ডলার মূল্যের ইতালীয় হাতব্যাগ, মুক্তোর নেকলেস, চোখ ধাঁধানো ডিজাইনার সালোয়ার কুর্তা ইত্যাদি!

Advertisement

তবে হিনার চেয়ে পাক ফরেন সার্ভিসের ১৯৮৪ ব্যাচের ক্যাডার তেহমিনা অনেক বেশি পোড় খাওয়া কূটনীতিক বলেই মনে করছে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক। পাকিস্তানের কাছে সময়টাও এখন অনেক বেশি অস্বস্তির। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া-নীতির প্রবল চাপ কোণঠাসা করে রেখেছে ইসলামাবাদকে। ভারতের সঙ্গে গত আড়াই বছর ধরে বন্ধ থাকা আলোচনা ফের শুরু করতে উৎসুক নওয়াজ সরকার। কূটনীতিক মহলের বক্তব্য, ক্ষমতায় এসে ট্রাম্প যে ভাবে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করছেন তাতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাত কিছুটা হলেও শক্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে নওয়াজ উদ্‌গ্রীব মরিয়া মূলত দু’টি কারণে। এক, এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-কৌশলগত রাজনীতিকে সুস্থির রাখার ক্ষেত্রে পাক-উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তুলে ধরা সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, আলোচনা শুরু হলে তবেই কাশ্মীর প্রসঙ্গকে ফের টেবিলে নিয়ে এসে ভারতের উপরে পাল্টা চাপ দেওয়া সম্ভব হবে। যেটা ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে।

আরও পড়ুন:

অস্ট্রেলিয়াকে দুর্বলতম বলায় টুইটারে ভাজ্জিকে ট্রোল ওয়ার্নারের

মূলত এই দ্বিতীয় কারণেই তেহমিনা জানজুয়াকে ব্যক্তিগত ভাবে নওয়াজ বেছে নিয়েছেন বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। তাঁর প্রয়োজন ছিল এমন এক জন কূটনীতিকের, যিনি স্বভাবগত ভাবে কর্কশ নন। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কিছুটা চিনির মোড়ক দিয়ে রাখতে পারবেন যিনি। কিন্তু একই সঙ্গে কাশ্মীর প্রসঙ্গে অনমনীয় অবস্থানও নিতে পারবেন। গত বছরের শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে বুরহান ওয়ানির মৃত্যু পরবর্তী অশান্ত কাশ্মীর নিয়ে আক্রমণাত্মক হয়েছিল ভারত-পাকিস্তান দু’টি দেশই। পাকিস্তানের হয়ে লাগাতার ব্যাট করেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জে সেই সময়ে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি এই তেহমিনা। কাশ্মীরে ভারত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে— রাষ্ট্রপুঞ্জে এই প্রচারের পুরোধা ছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে কোনও আক্রমণ তো দূরস্থান, ভারতীয় অফিসারদের সঙ্গে সখ্যের সম্পর্কই বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।

এ রকম এক জনেরই প্রয়োজন ছিল নওয়াজের। প্রাথমিক ভাবে কথা ছিল, বর্তমানে ভারতে নিযুক্ত পাক হাইকমিশনার আব্দুল বাসিতই বিদেশসচিবের পদটি পাবেন। কিন্তু গত তিন বছরে ভারতকে আলোচনার পথে ফেরাতে ব্যর্থ, কিছুটা কট্টরপন্থী বাসিতের নিয়োগ শেষ পর্যন্ত নাকচ করে দেওয়া হয়। পঞ্জাব প্রদেশের বিদূষী, সুন্দরী, কবিতাপ্রেমী কূটনীতিক তেহমিনা শেষ পর্যন্ত মিছরির ছুরি হয়ে ওঠেন কি না— আপাতত সেদিকেই নজর রাখছেন জয়শঙ্কর এবং তাঁর বাহিনী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন