চাহিদার রহস্যভেদকেই নোবেল স্বীকৃতি

এ বছরের নোবেল পুরস্কারের প্রাপক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ অ্যাংগাস ডিটনের নাম ঘোষণা করে নোবেল কমিটি জানাল, ভোগব্যয়, দারিদ্র এবং উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর কাজের জন্যই এই পুরস্কার।

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৫ ০২:৪১
Share:

এ বছরের নোবেল পুরস্কারের প্রাপক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ অ্যাংগাস ডিটনের নাম ঘোষণা করে নোবেল কমিটি জানাল, ভোগব্যয়, দারিদ্র এবং উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে তাঁর কাজের জন্যই এই পুরস্কার।

Advertisement

জন্মসূত্রে স্কটিশ, কর্মসূত্রে মার্কিন, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়া এই অর্থনীতিবিদের কাজের পরম্পরায় এই ঘোষণার মাহাত্ম্য টের পাওয়া যাবে। ১৯৮০ সালে ভোগব্যয় নিয়ে তাঁর ও জন মুয়েলবাওয়ার-এর কাজ অর্থনীতির দুনিয়ার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। সে বছরই প্রকাশিত হয় ‘ইকনমিকস অ্যান্ড কনজিউমার বিহেভিয়র’, যেখানে তাঁরা প্রকাশ করেন তাঁদের তাত্ত্বিক মডেল, কখন কোন পণ্যের জন্য কোন অর্থনৈতিক শ্রেণির মানুষের কতখানি চাহিদা থাকবে, তা বোঝার জন্য আজও যে মডেলের বিকল্প নেই। এই মডেল থেকেই বোঝা সম্ভব, কোনও পণ্যের ওপর কর বাড়ানো বা কমানো হলে তা কোন শ্রেণির মানুষের জীবনে কতখানি প্রভাব ফেলতে পারে, অথবা কোনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করতে চাইলে তার জন্য কোন পথে হাঁটতে হবে। অর্থনীতির গবেষকরা যেমন, তেমনই নীতিনির্ধারকরাও ডিটনের তত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল।

১৯৯০-এর দশকে ডিটনের কাজের মূল বিষয় ছিল ভোগব্যয়ের সঙ্গে দারিদ্রের সম্পর্ক। অর্থনীতির যে শাখা সামগ্রিক অর্থনীতি নিয়ে কাজ করে, সেই ম্যাক্রোইকনমিকস-এ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্যক্তির গুরুত্ব। দেখিয়েছিলেন, সমাজে সামগ্রিক ভাবে আয় বৃদ্ধি বা হ্রাসের সঙ্গে সঞ্চয়ের যে সম্পর্ক, ব্যক্তিগত স্তরে সম্পর্কটি তার চেয়ে ঢের আলাদা। অর্থনীতির প্রচলিত তত্ত্বে সেই সম্পর্ক ধরা পড়বে না। জন মেনার্ড কেইনস থেকে মিলটন ফ্রিডম্যান অবধি ম্যাক্রোইকনমিকস যে পথে চলেছিল, অ্যাংগাস ডিটনের প্রভাবে সেই চলন কিছুটা বদলে গেল। এখন অর্থনীতির ভোগ-সঞ্চয়ের সামগ্রিক ছবি দেখার আগে গবেষকরা দেখে নেন, ব্যক্তিগত স্তরে ছবিটা কেমন।

Advertisement

সাম্প্রতিক কালে ডিটন ডিমান্ড সিস্টেম এবং ভোগব্যয় বিষয়ে তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতাকে নিয়ে এসেছেন উন্নয়ন অর্থনীতির কাজে। নোবেল কমিটির মতে, তাঁকে পুরস্কৃত করার তৃতীয় কারণ এই কাজ। কর্মজীবনের সব কাজই নোবেলে স্বীকৃতি পাচ্ছে, এমন ঘটনা বিরল। ডিটন সেই বিরল কৃতিত্বের অধিকারী।

উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে ডিটনের গবেষণার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ভারত। তিনি একাধিক বার কলকাতাতেও এসেছেন। নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছিল, ভারতে অর্থনৈতিক ভাবে দরিদ্রতর শ্রেণির আয় বাড়লেও তাদের ক্যালরি ভোগের মাত্রা কমেছে। অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজের সঙ্গে একটি গবেষণাপত্রে ডিটন দেখান, তাতে অস্বাভাবিকতা নেই। কারণ, আগের তুলনায় মানুষের পছন্দ বদলেছে, উন্নত হয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবার মানও। এবং কমেছে শারীরিক পরিশ্রমের চাহিদা। ফলে, তাঁরা কম ক্যালরি পাচ্ছেন।

জঁ দ্রেজ বললেন, ভারতের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণে দু’দিক থেকে ডিটনের প্রভাব আছে। তিনি দেখিয়েছেন, সামাজিক ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আবার, কী ভাবে সেই নীতি রূপায়ণ করা প্রয়োজন, তা-ও ডিটনের থেকে শেখার। তিনি দেখিয়েছেন, প্রক্রিয়াটি গণতান্ত্রিক, আলোচনাভিত্তিক হওয়াই বিধেয়, ওপর থেকে নীতি চাপিয়ে দেওয়া চলবে না।

ভোগব্যয়ের পরিমাপকে কী ভাবে উন্নয়নের মাপকাঠি করে তোলা যায়, দেখিয়েছেন ডিটন। পরিবারে মেয়ে সন্তানরা কি অবহেলিত, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য তিনি মাপতে চেয়েছিলেন, পরিবারে সন্তান জন্মালে প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন ভোগব্যয়, যেমন জামাকাপড়ের পিছনে ব্যয় মেয়ের তুলনায় ছেলের ক্ষেত্রে বেশি কমে কি না। তা হলেই বোঝা যাবে, ছেলে সন্তানের পিছনে বেশি টাকা খরচ করা হয় কি না।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এর অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটকের মতে, ‘তত্ত্ব এবং তথ্যবিশ্লেষণের মাধ্যমে ডিটন প্রায় সারা জীবন একটাই মৌলিক অর্থনৈতিক প্রশ্নের নানা দিক নিয়ে কাজ করেছেন: মানুষের ভোগ্যপণ্য চয়ন বিশ্লেষণ করে কী করে দারিদ্র এবং সচ্ছলতা মাপা হবে। ডিটনের কাজ অর্থনীতির এক ধ্রুপদী ঘরানার। বাস্তবমুখী এবং আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ বিষয় নিয়ে গভীর এবং নীতি-নির্ধারণের জন্যে আবশ্যক তাঁর কাজ। পরবর্তী কালে অসাম্য নিয়ে অ্যান্টনি অ্যাটকিনসন ও টমাস পিকেটির কাজ তাঁর গবেষণার সঙ্গে তুলনীয়।’ আইএসআই-এর অধ্যাপক অভিরূপ সরকারও সহমত। বললেন, ‘তত্ত্বের সঙ্গে ক্ষেত্রসমীক্ষা, জটিল অঙ্কের সঙ্গে পরিসংখ্যানকে মিলিয়ে দেওযার এই চেষ্টাই ডিটনকে অন্য অর্থনীতিবিদদের থেকে আলাদা করেছে।’

৬৯ বছর বয়সী দীর্ঘদেহী অ্যাংগাস ডিটন মানুষ হিসেবেও বর্ণময়। ভোজনরসিকও বটে। অভিরূপবাবু বললেন, ‘এক বার আইএসআই-এর নৈশভোজে ডিটন যে পরিমাণ বিরিয়ানি আর প্রবল মশলাদার পাঁঠার কোর্মা খেয়েছিলেন, সেটা মনে রাখার মতো!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন