Bangladesh Election 2024

টানা চার দফা, হাসিনা যেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা

প্রশ্নে-সংশয়ে ‘জর্জরিত’ নির্বাচনটি হেলায় উতরে দিয়ে সোমবার নিজের বাসভবনের উদ্যানে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের মুখোমুখি হলেন বাংলাদেশের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

Advertisement

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়

ঢাকা শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ০৫:৫২
Share:

ঢাকায় নিজের বাসভবনে সাংবাদিক বৈঠকে শেখ হাসিনা। সোমবার। ছবি: রয়টার্স।

টানা চার বার আর সব মিলিয়ে পাঁচ বার প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে চলেছেন তিনি। মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইন্দিরা গান্ধী, শ্রীলঙ্কার সিরিমাভো বন্দরনায়ক, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার বা ইজ়রায়েলের গোল্ডা মেয়ারকেও ছাপিয়ে গেলেন। প্রশ্নে-সংশয়ে ‘জর্জরিত’ নির্বাচনটি হেলায় উতরে দিয়ে সোমবার নিজের বাসভবনের উদ্যানে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এবং পর্যবেক্ষকদের মুখোমুখি হলেন বাংলাদেশের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিছুক্ষণ আগে যাঁকে একে একে সাধুবাদ জানিয়ে গিয়েছেন ভারত, চিন, রাশিয়া, ভুটান-সহ নানা দেশের কূটনৈতিক প্রধানেরা, কিছুক্ষণ পর পরই অভিনন্দনের ফোন এসেছে রাষ্ট্রপ্রধানদের।

Advertisement

পরনে আসমানি ঢাকাই, মাথায় আলগা ঘোমটা, বছর ৭৬-এর প্রধানমন্ত্রী যখন তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলেন সবুজ ঘাসে ঢাকা লনে, তাল রাখতে পার্শ্বচরেরা দুদ্দাড়ে দৌড়চ্ছেন। হাসিনা অনায়াসে মিশে গেলেন অপেক্ষারত ১১টি দেশের সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের ভিড়ে। প্রত্যেকের চোখে চোখ রেখে জোড় হাতে সৌজন্য বিনিময় করলেন। বিলক্ষণ জানতেন যে, এই ভিড়ে মিশে রয়েছেন আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকেরা, ছুতো খুঁজে নির্বাচনকে অসিদ্ধ বলতে যাঁরা রবিবার ঢুঁড়ে ফেলেছেন বাংলাদেশ।

রেকর্ড ভাঙা মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেমন লাগছে— উড়ে এল প্রথম প্রশ্ন। কপাল কুঁচকে এক লহমা ভাবলেন, তার পরে বললেন— “মানুষ আমাকে দেশ শাসনের দায়িত্ব দিয়েছেন। প্রশাসকের আবার পুরুষ-মহিলা কী!” জানালেন, নিজেকে তিনি মহিলা প্রধানমন্ত্রী নন, শুধু প্রধানমন্ত্রী বলেই মনে করেন। তাঁর কথায়, “তবে আমি মহিলা তো বটেই। মায়ের জাত। এই বয়সে এসে দেশবাসীকে সন্তানবৎই মনে করি।” এবং বিনয়। একটু খাদে নামল গলা। হাসিনা বলে চললেন, “ইন্দিরা গান্ধী, বন্দরনায়ক, থ্যাচাররা বড় বড় মানুষ। আমি নগণ্য, নেহাতই সাধারণ। অত লেখাপড়ার সুযোগ আমার হয়নি। তবে ছোট বয়সে বাবা-মা, তিন ভাই, দুই ভাবিকে হারিয়েছি। খুনিদের ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি দেশ থেকে দেশে। গরিব মানুষের দুঃখটুকু আমি বুঝি।”

Advertisement

প্রশ্নোত্তরের আগে সংক্ষিপ্ত ভাষণে হাসিনা বলেছেন, “১৯৮৬ থেকে এ পর্যন্ত ৮ বার ভোটে লড়েছি। কখনও রক্ত ঝরিয়ে, কখনও বিনা রক্তপাতে বারে বারে বাংলাদেশে নির্বাচনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা গণতন্ত্রের দাবিতে লড়াই করে গিয়েছি। এ বার দেখি আমাদের নিয়ে কত কথা! কোনও বার আমাদের ভোট নিয়ে অন্যদের এমন আগ্রহ দেখিনি।” প্রধানমন্ত্রী জানান, সেই জন্য তাঁরা দুনিয়ার কাছে দরজা খুলে দিয়েছিলেন। যারা প্রশ্ন তুলছে, তারা এসে ভোট প্রক্রিয়া দেখে যাক। উচ্চারণ করলেন, “এ বার ভোটে দেশের মানুষ আমাকে নয়, গণতন্ত্রকে জিতিয়েছেন। সেনাশাসক (জেনারেল জিয়াউর রহমান)-এর ঘরে জন্মানো যে দলটি (বিএনপি) ভোট বয়কট করে দেশবাসীকে গণতন্ত্র শেখাতে গিয়েছিল, মানুষ তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেছেন।”

প্রাথমিক বিনয়টুকু বাদ দিয়ে চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী হাসিনা এ দিন ছিলেন টি-টোয়েন্টির মেজাজে। মুখোমুখি বসা আমেরিকার পর্যবেক্ষক তাঁকে প্রশ্ন করার আগেই হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, “ভোট কেমন দেখলেন ঘুরেফিরে?” ওয়াশিংটন থেকে আসা সেই পর্যবেক্ষক জবাবে বললেন, প্রাথমিক ভাবে তাঁদের মনে হয়েছে মানুষের মধ্যে ভোট দেওয়ার আগ্রহ ছিল। এটা ভাল। এর পরে হসিনার দ্বিতীয় প্রশ্ন, “আমেরিকার ভোট আর বাংলাদেশের ভোটের মধ্যে কোনটা বেশি ভাল?” পর্যবেক্ষক বললেন, “বাংলাদেশের ভোট নিয়ে অনেক বেশি প্রশ্ন উঠেছিল...।” এ বার মাইক তুলে নিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে হাসিনা একটানা শুনিয়ে গেলেন, “আপনারা বড় দেশ, শক্তি বেশি বলে কেউ বলে না। আমরা ছোট দেশ তো। কিন্তু মনে রাখবেন, আমাদেরও সার্বভৌমত্ব আছে। যে যা খুশি বলে যাবেন, আমাদের ভাল লাগে না সেটা।” তার পরেই জানিয়ে দিলেন, দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ বৈঠকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর সঙ্গে কথা বলে কেমন উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তাঁকে সকন্যা ডেকে নিজস্বীও তুলেছিলেন।

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় হাসিনা জানালেন, দুই প্রতিবেশী দেশের সখ্য ইতিহাসের কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের অবদান ভোলার নয়। কিছু মতভেদ যেমন আছে, আলোচনার টেবিলে তা মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও রয়েছে। তারও আধঘণ্টা পরে, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজের মুখে ভোটের ফলাফল ঘোষণার পরে নরেন্দ্র মোদী ফোন করে অভিনন্দন জানান হাসিনাকে। এক্স হ্যান্ডলে মোদী লেখেন, “দু’দেশের মধ্যে সহনশীল এবং মানুষের প্রয়োজনভিত্তিক সহযোগিতা দৃঢ় করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমরা।” জয় প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘জয় তো জয়ই। সপরিবার ভাল থাকুন। অন্য সকলেই ভাল থাকবেন।’’

বলছেন গণতন্ত্রের জয়, অথচ কার্যত বিরোধীহীন সংসদ— বিষয়টি কাঁঠালের আমসত্ত্ব হল না কি? ছক্কা হাঁকানোর ভঙ্গিতে হাসিনা বললেন, “বিরোধী দলটাকেও আমাকে দেখতে হবে? তারা কেন ভোট পেল না, সেটাও আমার দায়? মানুষ আমাকে শাসক দলের দায়িত্ব দিয়েছে, বিরোধীদের নিয়ে আমি ভাবব না!”

হাসিনা জানালেন, ফের ফেরায় তাঁর নজরে এ বার ২০৪১ সাল। এখন মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদা পাওয়া বাংলাদেশকে ২০৪১-এর মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। এর মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবেন তিনি। সমৃদ্ধ বাংলাদেশে থাকবে দৃঢ় অর্থনীতি, থাকবে না কর্মসংস্থানের সঙ্কট। গণভবনকে ছায়ায় রাখা গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পাটে বসছে শীতের সূর্য। সকলকে বিদায় জানিয়ে তিনি উঠে গেলেন সিঁড়ি ভেঙে, যেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন