শহিদবেদিতে মালা দিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। নিজস্ব চিত্র।
প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে নাম না করে চিনের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিলেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রশান্ত মহাসাগরের সবুজ দ্বীপগুলিতে চিনা সেনার প্রবল আধিপত্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে মুখ খুলেছেন তিনি। জানিয়েছেন, সমুদ্র-যোগাযোগের পথ সন্ত্রাসমুক্ত হওয়া আবশ্যক। এখানে রেষারেষির কোনও জায়গা নেই। পাশাপাশি এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলির উন্নয়নে নয়াদিল্লির আগ্রহের দিকটিও বিশদে তুলে ধরেছেন প্রণববাবু।
এই গোটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় বিদেশনীতিতে এক সম্পূর্ণ নতুন অধ্যায় শুরু হল বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল। নতুন, কেননা, ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই দেশে হাজার তিনেক ভারতীয় কর্মী কাজ করলেও, কোনও ভারতীয় মন্ত্রী বা সরকারি নেতার পদচিহ্ন পড়েনি এখানকার ঘাসে। আর তাই, পাপুয়া নিউগিনির রাজধানী পোর্ট মরিসবিতে বিমান নামার আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সহাস্য প্রশ্ন, ‘‘কারা এখানে এসেছেন এর আগে হাত তুলুন!’’ বিমানে তখন জনা বিশেক সাংবাদিক ছাড়াও তার দ্বিগুণ সংখ্যক অফিসার, বিমানকর্মী, সাংসদেরা। স্বাভাবিক ভাবেই একটি হাতও উঠল না! রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও প্রতিমন্ত্রীও এঁর আগে আসেননি। আর তাই আমি এলাম! প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলির সঙ্গে ভারতের যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।’’
ঘটনা হল, গত কয়েক মাস ধরেই এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্ক শুরু করার লক্ষ্যে নড়েচড়ে বসেছে মোদী সরকার। প্রাকৃতিক গ্যাসে ভরপুর পাপুয়া নিউগিনিতে তিন মাস আগে সিআইআই-এর একটি প্রতিনিধি দল এসে ঘুরে গিয়েছে। এখান থেকে ভারতে গ্যাস রফতানি নিয়ে কথা হয়েছে। তারও আগে তৈরি করা হয়েছে ইন্ডিয়া প্যাসিফিক আইল্যান্ড কোঅপারেশন (ফিপিক)। গত অগস্টে জয়পুরে তার সম্মেলনও হয়ে গিয়েছে। সাউথ ব্লকের মাথাব্যথার অন্যতম কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরে একাধিপত্ব ক্রমশই বাড়িয়ে চলেছে বেজিং। চিনা মডেলটি সহজ এবং চিরাচরিত। অর্থনৈতিক অনুদানে দ্বীপগুলিকে চুবিয়ে দিয়ে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার ছাড়পত্র আদায় করে নেওয়া। জলপথের অধিকার নিয়ে বৃহত্তর অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত সুবিধা কায়েম করা। তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাঁড়ার এই সবুজ দ্বীপকে কব্জায় রাখতে পারলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে নয়াদিল্লিকে টেক্কা দেওয়া যাবে, এ কথা মাথায় রেখেই বেজিং-এর এই পদক্ষেপ বলেই মনে করছেন বিদেশমন্ত্রকের কর্তারা। সম্প্রতি চিনের প্রধানমন্ত্রী শিজিংপিং এক ঢালাও অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন এখানকার ১৪টি দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য। চিনের সামরিক উপস্থিতি এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের পক্ষ থেকে দ্বিপাক্ষিক স্তরে গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের কাছে বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রের খবর। গত এক বছর ধরে এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের তালিকায় তুলে আনা হয়েছে এবং তার ফসল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আজ থেকে শুরু হওয়া দু’দিনের সফর।
চোখ জুড়নো সবুজ আর উঁচু-নিচু টিলায় ঘেরা এই দ্বীপে নামার পর থেকেই, অবধারিত ভাবে চিন নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে। দীর্ঘ দিনের বিদেশমন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতায় ভর দিয়ে তিনি তার মোকাবিলাও করছেন কূটনৈতিক ভাবে। গোটা অঞ্চলে চিনা সেনার প্রবল উপস্থিতির প্রেক্ষিতে কী ভাবে তিনি দেখছেন ভারত এবং পাপুয়া-নিউ দিল্লির সম্পর্ক? তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায় জবাবে জানিয়েছেন, ‘‘সমস্ত সমুদ্র যোগাযোগ সংঘর্ষমুক্ত এবং লড়াইবিহীন হওয়া বাঞ্ছনীয়। আজ গোটা বিশ্বের উদ্বেগের কারণ সন্ত্রাসবাদ সমুদ্র-নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলি। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রগুলির জলপথ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলি যদি চোরাচালান, মাদক পাচার, মানুষ পাচারের মতো বেআইনি কাজে ভরে যায় তা হলে তার প্রভাব পড়বে দ্বীপরাষ্ট্রগুলির সামগ্রিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তায়।’’ ভারত যে পাপুয়া নিউগিনির বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে এগিয়ে আসতে উৎসুক, এ কথাও আজ ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রপতি।
চিনের দিকে তাকিয়ে মোদী সরকার যে এই গোটা পদক্ষেপটি করছে, তা আজ স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল।