Pro-Assad Force

আলেপ্পোয় আসাদবিরোধী বিদ্রোহ পতনের মুখে, নির্বিচারে গণহত্যার অভিযোগ

এ এক বিশ্বাসভঙ্গের গল্প। একটি সম্ভাবনার মৃত্যুরও গল্প। আর কয়েক দিন বা মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। সিরিয়ার আলেপ্পো শহর এ বার পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের সেনার কব্জায় চলে আসছে। সেখানে বিদ্রোহের শেষ দীপ নিভু নিভু। যে দীপ জ্বালাতে মদত দিয়েছিল স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

Advertisement

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৯:৫৪
Share:

শেষ লড়াই। আলেপ্পোয় বিদ্রোহীরা। ছবি: এফপি।

এ এক বিশ্বাসভঙ্গের গল্প। একটি সম্ভাবনার মৃত্যুরও গল্প। আর কয়েক দিন বা মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা। সিরিয়ার আলেপ্পো শহর এ বার পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের সেনার কব্জায় চলে আসছে। সেখানে বিদ্রোহের শেষ দীপ নিভু নিভু। যে দীপ জ্বালাতে মদত দিয়েছিল স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হাত ধরেছিল ইউরোপের বড় শক্তিরা। সাহায্য করেছিল সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের মতো সুন্নি দেশগুলি। আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং মৌলবাদ-মুক্ত শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর সেই চেষ্টা শেষ হতে চলেছে। এবং ওবামা নয়, শেষ হাসিটি হাসতে চলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

Advertisement

আর পাঁচটা শহরের থেকে অনেকটাই আলাদা আলেপ্পো। ভূমধ্যসাগরের তীরে এ অঞ্চলের ইতিহাস শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব একবিংশ শতক থেকে। কালের ঝ়ড়-ঝাপটা সয়ে এত দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল আলেপ্পো। ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট হিসেবে আলেপ্পো স্বীকৃত। ইতিহাস বলছে এক সময়ে সফল বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল আলেপ্পো। স্বাধীন সিরিয়ায় অন্যতম শিল্পকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আলেপ্পো।

আর আজ প্রায় ধ্বংসস্তুপ, শ্মশান হয়ে যাওয়া সেই শহরের ধুলোমলিন পথে বিজয়গর্বে এগিয়ে চলেছে আসাদের সেনা। মুহুর্মুহু হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া ও সিরিয়ার বায়ুসেনা। শুধু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে শহরবাসী। এর মধ্যেই সিরিয়ার সেনা গণহত্যা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। এর মধ্যেই গণহত্যায় ৮২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। বাড়িতে ঢুকে ঢুকে মারা হয়েছে বলেও অভিযোগ। বিদ্রোহীদের যেটুকু প্রতিরোধ বেঁচে আছে তাও যখন-তখন ভেঙে পড়তে পারে।

Advertisement

আরও খবর:- প্রকাশ্যে বোরখা ছাড়া ছবি তুলে পোস্ট, সৌদি তরুণী জেলে

তার পরে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি। শহরের পশ্চিম দিকে বিদ্রোহীরা। অন্য দিকে আসাদের সেনা। কখনও আসাদের সেনা কিছুটা এগিয়ে আসে। কখনও বিদ্রোহীরা নতুন এলাকার দখল নেয়। আর এর মাঝে শহরটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হেরিটেজ সাইটগুলি পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। বিদ্রোহীদের ঠেকাতে আলেপ্পো জুড়ে ব্যারেল বোমা ফেলতে শুরু করে আসাদের বায়ুসেনা। কিন্তু সে বোমায় শুধু বিদ্রোহীরা মরে না। মরে সাধারণ মানুষ। মরে শিশু ও নারীরাও।

সিরিয়া যখন উত্তাল, আসাদের গদি যখন টলোমলো, তখন প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল পশ্চিমী বিশ্ব। সিরিয়া সেনার গণহত্যা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতেও দ্বিধা ছিল। কারণ, এই সুন্নি বিদ্রোহীদের সঙ্গে মৌলবাদীদের যোগাযোগ। তবে পরে দ্বিধা কাটে। আলেপ্পোয় মৌলবাদের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন বিদ্রোহীরা এক সঙ্গে করে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরি হয়। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব সমর্থন করে তাদের। অস্ত্র ও অর্থ জোগায়। সৌদি আরব-সহ সুন্নি দেশগুলিও সমর্থন করেছে। বিপদে-আপদে এই বিদ্রোহীদের পিছনে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’কে রাজনৈতিক ভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। সিরিয়া সংক্রান্ত শান্তি আলোচনায় তাদের প্রতিনিধিরা যোগ দেয়।

জয় এসেছে আসাদের। ধ্বংসস্তূপ আলেপ্পো। ছবি: এএফপি।

কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে দেয় ঝড়ের বেগে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান। বিশ্বের নজর যেন আইএস-এর দিকেই সরে যায়। আর আলেপ্পো জুড়ে সেনা আর বিদ্রোহীদের ঘাত-প্রতিঘাত চলতে থাকে। মাঝে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আটকে পড়ে কয়েক লক্ষ নাগরিক।

আইএস যতই ক্ষমতাশালী হয়েছে ততই বিশ্বের নজর আলেপ্পো থেকে সরে গিয়েছে। আর ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-র অর্থ আর অস্ত্রের যোগানে ততই টান পড়েছে। আর লড়াইটা ক্রমাগত ত্রিমুখী হয়ে গিয়েছে।

‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’কে এক দিকে সিরিয়ার সেনার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। অন্য দিকে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে আইএস-এর বিরুদ্ধেও লড়তে হচ্ছে। অর্থ আর অস্ত্রের জোগান আশ্বাসই রয়ে গিয়েছে।

তার পরেও হয়তো বিদ্রোহ চলত, কিন্তু সব সমীকরণ বদলে দেয় রাশিয়া। আসাদের সমর্থনে রাশিয়া সেনা যুদ্ধে নামার পর থেকেই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আইএস নয় ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’। রাশিয়ার বায়ুসেনার প্রবল হানার সামনে কার্যত অসহায় ছিল ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’। সিরিয়ার সেনার সঙ্গে এসে যোগ দেয় ইরানের শিয়া মিলিশিয়ারা। এই চাপ সামালানো অসম্ভব ছিল ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-র কাছে। তার পরেও সে ভাবে সাহায্য জোটেনি। শুধু মাঝে আটকে থাকা নাগরিকদের উদ্ধারের জন্য সরব হয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলি। সরব হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। ত্রাণ পৌছেছে। কিন্তু ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-র হাত শক্ত করার কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আলেপ্পো ও সন্নিহিত অঞ্চলে ক্রমেই জোরালো হয়েছে আসাদের মুঠি।

আজ সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে চলেছে। সিরিয়াকে আসাদ বিহীন করা আপাতত দুর অস্ত্‌। ওবামা কথা রাখতে পারেননি। ‘রাশিয়া প্রেমী’ ডোনাল্ড ট্রাম্প আদৌ এ সবের তোয়াক্কা করবেন না। শেষ সম্বলটুকু নিয়ে পালিয়ে আসা নাগরিকদের অনেকেই বিজয়ী সেনার আস্ফালনের পীড়ন নীরবে সইবেন। আবার একটি জয় ঝুলিতে পুরলেন ভ্লাদিমির পুতিন। আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল সিরিয়ার ভবিষ্যত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন