নোবেল মার্কিন অর্থনীতিবিদের

ইচ্ছেকে স্বীকার করেই ইচ্ছে নিয়ন্ত্রণ

প্রত্যাশিত উত্তরই বটে। এমআইটি-র অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আচরণবাদী অর্থনীতি নামক ধারাটির অন্যতম জনক থেলার। মানুষের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে যে অসংখ্য ‘বায়াস’ বা যুক্তিহীন পক্ষপাত থাকে, সেগুলোকে যে আসলে গোটাকয়েক খুব সহজ ধারণার মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়, এই কথাটা সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে থেলারই বলেছেন।’’

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৭ ০১:৪৮
Share:

পরামর্শ: সাংবাদিকদের কাছে যাওয়ার আগে কোন জামাটা, আলোচনা স্ত্রীর সঙ্গে। শিকাগোয় নিজের বাড়িতে রিচার্ড। ছবি: রয়টার্স

পুরস্কারের টাকা খরচ করবেন কী ভাবে? উত্তরে এ বছরের অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল অব বিজনেস-এর ৭২ বছর বয়সী অধ্যাপক রিচার্ড এইচ থেলার জানালেন, ‘যতখানি যুক্তিহীন ভাবে সম্ভব!’

Advertisement

প্রত্যাশিত উত্তরই বটে। এমআইটি-র অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আচরণবাদী অর্থনীতি নামক ধারাটির অন্যতম জনক থেলার। মানুষের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে যে অসংখ্য ‘বায়াস’ বা যুক্তিহীন পক্ষপাত থাকে, সেগুলোকে যে আসলে গোটাকয়েক খুব সহজ ধারণার মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়, এই কথাটা সবচেয়ে স্পষ্ট ভাবে থেলারই বলেছেন।’’

আরও পড়ুন: নোবেল পেতে পারেন রঘুরাম রাজন? সংস্থার তালিকা ঘিরে জল্পনা তুঙ্গে

Advertisement

র‌্যাশনালিটি। যুক্তিগ্রাহ্যতা। অর্থনীতির যে কোনও কলেজপাঠ্য বই খুললেই খোঁজ মিলবে ‘র‌্যাশনাল ম্যান’-এর— যে সব সময় নিজের ভালর কথা মাথায় রেখে যে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ শতকের মাঝখান থেকে অর্থনীতির দুনিয়ায় প্রশ্ন উঠতে থাকে এই র‌্যাশনালিটি নিয়ে। রিচার্ড থেলারও সেই প্রশ্নই তুলেছেন। তাঁর প্রশ্নটি এসেছে মনস্তত্ত্বের দুনিয়া থেকে— মনস্তত্ত্ব আর অর্থনীতির মিশেলেই তৈরি হয়েছে আচরণবাদী অর্থনীতির ধারা। থেলারের মত, হরেক কারণে মানুষ এমন সিদ্ধান্ত করে, যা যুক্তিসঙ্গত নয়। এই আপাত-যুক্তিহীনতাকে ধরেই তৈরি করতে হবে অর্থনীতির তত্ত্ব। কেন? থেলারের মতে, ‘‘অর্থনীতিতে ভাল কাজ করতে হলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, মানুষ আসলে মানুষই।’’

থেলার দেখিয়েছেন, ঠিক কোন কোন জায়গায় মানুষের সিদ্ধান্ত যুক্তিহীন হয়ে যায়। এবং কী ভাবে তাদের ফিরিয়ে আনা যায় যুক্তির পথে— তাঁর গবেষণা সে কথাও বলেছে। কী ভাবে ব্যবস্থায় সামান্য পরিবর্তনের মাধ্যমেই মানুষকে তার নিজের ভালর পথে ফিরিয়ে আনা যায়, থেলারের গবেষণার বড় অংশ জু়ড়ে রয়েছে সেই তত্ত্ব। ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের। থেলাররা যার নাম দিয়েছেন ‘লিবার্টারিয়ান প্যাটার্নালিজম’ বা ‘উদারপন্থী নিয়ন্ত্রণবাদ’।

লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক বললেন, ‘‘অর্থনীতির তত্ত্বে তো বটেই, সরকারি নীতি প্রণয়নেও থেলারের গুরুত্ব অপরিসীম। আমেরিকায় পেনশন প্রকল্প থেকে বাচ্চাদের স্কুলের ক্যান্টিনে হাতের নাগালে ফাস্ট ফুড না রাখার সিদ্ধান্ত, থেলারের কাজ প্রভাব ফেলেছে বহু ভাবে।’’

বিশ্বব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বললেন, ‘‘মানুষের অর্থনৈতিক আচরণের যুক্তিহীনতাকে বেসরকারি ক্ষেত্র নিজেদের লাভের জন্য বহু দিন ধরেই ব্যবহার করে এসেছে। থেলাররা দেখিয়েছেন, কী ভাবে মানব উন্নয়নের কাজে তার ব্যবহার সম্ভব। বিশ্বব্যাঙ্কে আমার তত্ত্বাবধানে প্রথম যে ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বেরিয়েছিল, তার ভিত্তিই ছিল থেলার এবং আর কয়েক জন আচরণবাদী অর্থনীতিবিদের কাজ।’’

কিন্তু আজকের দুনিয়ায় যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে নরেন্দ্র মোদী, প্রত্যেকেই নাগরিকদের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সেখানে থেলারের এই তত্ত্বের নোবেলপ্রাপ্তি কি বিপজ্জনক নয়? ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতার অধিকর্তা, অর্থনীতিবিদ অচিন চক্রবর্তী বললেন, ‘‘থেলারকে আলাদা করে দেখতে হবে। ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণ হয় গায়ের জোরে। আর থেলাররা যে নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন, সেটা দূর থেকে, ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে, জোর না খাটিয়ে।’’ অচিনবাবুর মতে, ‘‘এই নোবেলের সব চেয়ে বড় তাৎপর্য হল, ক্রেতার ইচ্ছেই শেষ কথা এবং সেটাই ভাল, ভোগবাদের বাজার অর্থনীতির এই চালু কথাটা যে আসলে অচল, সেটা মনে করিয়ে দেওয়া।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন