ভস্মস্তূপ থেকে জেগে ওঠার অপেক্ষা

অবিরাম প্রচেষ্টায় বাঁচানো গিয়েছে মূল স্থাপত্যের কিছু অংশ এবং অমূল্য কিছু শিল্পসম্ভার। আর জেগে থাকছে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ-র প্রতিশ্রুতি, ‘‘আমরা নোত্র দামকে গড়ে তুলব আবার। গৌরবের জায়গায় ফিরিয়ে আনব।’’

Advertisement

শ্রেয়স সরকার (গবেষক)

প্যারিস শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৬:২৯
Share:

আগুনের গ্রাসে নোত্র দাম। ছবি: সংগৃহীত।

বেদনা হতে বেদনে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে সঙ্গীতমূর্ছনা। ভারাক্রান্ত বাতাসে ধাক্কা খেতে খেতে। ‘আভে মারিয়া’ (বিখ্যাত গাথাগীত) গাইছে জনতা। দগ্ধ সুর, দগ্ধ অভিব্যক্তি। সুর হচ্ছে শব্দের মুক্তি, বলেছিলেন প্রিয় কবি। কিন্তু মনের ভারের মুক্তি কই?

Advertisement

এক অবিস্মরণীয় ক্রন্দন-কল্লোলের মাঝখানে নোত্র দাম গির্জার গা ঘিরে, লতানে আগ্রাসনে বেড়ে উঠছে এক অবিস্মরণীয় অনল। জনতা কখনও স্তব্ধ, কখনও নিশ্চল। আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কি না, তা আর ভাবছে না প্যারিসবাসী। তাদের হৃদয়ের কতটুকু রক্ষা করা যায়, এটাই তাদের প্রার্থনার মূল সুর। আমি সেখানে মেলাচ্ছিলাম আমার সুর। ‘‘আচ্ছা, বলুন তো, এত হিংসা, এত দ্বেষ পেরোনোর পরে কিনা শেষে আগুনে শেষ আমাদের ফেয়ার লেডি’’, আমার পাশে দাঁড়ানো ফরাসি বৃদ্ধের শোকার্তি।

ফরাসি বিপ্লব এবং বিশ্বযুদ্ধে বেঁচে থাকা ইউরোপের প্রতীকী স্থানগুলির অন্যতম নোত্র দাম। দ্বাদশ শতকের পর থেকেই ফ্রান্স ও তার রাজধানী প্যারিসের সঙ্গে ওতপ্রোত এই গির্জা। ফরাসি রাজা চতুর্থ হেনরি এবং সম্রাট নেপোলিয়নের বিবাহের স্থান ছিল নোত্র দাম। ভিক্তোর উগোর উপন্যাস ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নোত্র দাম’-এর ফরাসি শিরোনাম ‘নোত্র-দাম দ্য পারি’। অর্থাৎ নোত্র দাম-ই প্যারিস। নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং নানা ভাবে উজ্জীবনের সঙ্কেতবাহী। আগুন লেগে যাওয়া মূল ছাদটি তৈরি হয়েছিল পাঁচ হাজার ওক গাছ দিয়ে। সোমবার ভেঙে যাওয়া ছাদটি ১৭৮৬ সালে সংস্কার করা হয়েছিল। ফের তৈরি হয় ১৮৬০-এ। যখন নেপোলিয়ন তৃতীয় ক্ষমতায় ছিলেন, ইউজ়েন-ইমানুয়েল ভায়োলেট-লে-ডুকের নকশায় পুনর্নির্মিত হয় এটি। সেন্ট টমাসের মূর্তির জন্য নিজেকে মডেল করেছিলেন ডুক। তিনি ছিলেন গথিক স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক। নোত্র দাম তাই বিশ্বে গথিক স্থাপত্য গরিমার প্রতিমূর্তি। এর মিনারে আরোহণ করলে এক অভাবনীয় দৃশ্য উন্মোচিত হত চোখের সামনে।

Advertisement

কান্না: প্যারিসের রাস্তায়। এএফপি

এই ক্যাথিড্রাল ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কযুক্ত। এর শৈল্পিক অঙ্গবিন্যাস, এর চিত্রসম্ভার, সঙ্গীত এবং সংগ্রহ সবই মহিমান্বিত। সেই মহিমময় ইতিহাস নিয়ে কথা হচ্ছিল বিখ্যাত ফরাসি পরিকল্পক সোনিয়া রাকিয়েলের পুত্র, সঙ্গীতবিদ জঁ ফিলিপ রাকিয়েলের সঙ্গে। ‘‘বহু কনসার্টের অংশীদার হিসেবে অনেক বারই আমি নোত্র দামে উপস্থিত ছিলাম,’’ বলতে বলতেই ফিলিপের অনুযোগ ঘুরে গেল তাঁর ঈশ্বরের দিকে: ‘‘এমন একটি সুন্দর ভবন যা একটি ধর্মের গৌরবকে উত্থাপিত করেছিল, ঈশ্বর, আপনার এখনও কি মনে হয়, আপনি নোত্র দামের যোগ্য প্রাপক?’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

আমি চুপ করে গেলাম। অনেকেই বলছিলেন, এ হল বিব্লিকাল। অপূরণীয় হিংসার সময়ে এ হল নোত্র দামের আত্মবিসর্জন। ঐতিহাসিক গির্জার অগ্নিস্নান এক অপরিমেয় ক্ষতি। শান্তির বারির প্রত্যাশা করছিলেন কেউ কেউ। ২০১৯-এর ফ্রান্স, চেতনাগত দিক থেকে এক বিভক্ত দেশ। প্যারিস আধুনিক সময়ের সন্ত্রাসী হিংসার অন্যতম রঙ্গমঞ্চ। তারই মধ্যে এ-হেন এক শান্তিস্থান পুড়ে গেল চোখের সামনে।

তবে অবিরাম প্রচেষ্টায় বাঁচানো গিয়েছে মূল স্থাপত্যের কিছু অংশ এবং অমূল্য কিছু শিল্পসম্ভার। আর জেগে থাকছে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ-র প্রতিশ্রুতি, ‘‘আমরা নোত্র দামকে গড়ে তুলব আবার। গৌরবের জায়গায় ফিরিয়ে আনব।’’

এখন শুধু ভস্মস্তূপ থেকে স্মৃতির ফিনিক্সের জেগে ওঠার অপেক্ষা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন