তখনও বেঁচে আলি দাকনিশ। আলেপ্পোর হাসপাতালে। ছবি: রয়টার্স
ওমরান দাকনিশকে এখন এক ডাকে চেনে গোটা বিশ্ব। দিন কয়েক আগে অ্যাম্বুল্যান্সের কমলা চেয়ারে বসা রক্তাক্ত একরত্তির মুখটা নিয়ে সংবাদমাধ্যম আর সোশ্যাল মিডিয়ায় কম হইচই হয়নি। ওমরানদের আলেপ্পোর বাড়িতে বোমা পড়েছিল গত বুধবার। তাতে আহত হয়েছিল তার গোটা পরিবার। পাঁচ বছরের ওমরানকে বাঁচানো গেলেও মারা গেল তার দশ বছরের দাদা আলি দাকনিশ। একটি ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা এ খবর জানিয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল আলির। তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাই বাঁচানো যায়নি তাকে।
আলি দাকনিশের মতো ওমরদের গল্পটাও প্রায় এক। বারো বছরের ওমর আর তার চেয়ে এক বছরের বড় মুফেদাহ। কাকার অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়িতে কম্বল বিছিয়ে শুয়েছিল দুই ভাই। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের রাস্তা থেকে কাকার বাড়ির সিঁড়িটুকু সুরক্ষিত বলে মনে হয়েছিল তাদের। এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন হঠাৎই খোঁজ পান তাদের। তাঁরাই দুই ভাইকে তুলে দেন আসমার হালাবির হাতে।
গোটা আলেপ্পোয় মাত্র একটাই অনাথ আশ্রম আছে। হালাবি আর তাঁর স্ত্রী-ই চালান সেটি। ওমরদের মতো অজস্র স্বজন-হারানো শিশুর আশ্রয় এখন ওই অনাথ আশ্রম। হালাবি জানাচ্ছেন, আলেপ্পোর মাথার উপর দিয়ে যতই যুদ্ধ-বিমান যাক না কেন, আশ্রমের কচিকাঁচারা কিন্তু সেখানে নিরুপোদ্রবে ঘুমোতে পারে। ওমরদের মতো কোনও শিশুকে যাতে তাদের আত্মীয়ের বাড়ির সিঁড়িতে আশ্রয় নিতে না-হয়, তাই মাটির তলায় দোতলা জুড়ে এক বিশাল জায়গায় শিশুদের থাকা-খাওয়া-শোয়ার ব্যবস্থা করেছেন হালাবি। আলেপ্পোর সেই মাটির তলার অনাথ আশ্রমে তাই নিশ্চিন্তে বড় হচ্ছে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত সিরিয়ার শৈশব।
সম্প্রতি এক রুশ বিমান-হানায় পিতৃহারা হয়েছিল ওমররা। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও। সব দেখেশুনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন তাদের মা। প্রথমে দুই শিশুর ঠাঁই হয়েছিল এক কাকার বাড়ি। কিন্তু কাকাই তাদের হাতে ভিক্ষাপাত্র ধরিয়েছিল। দিনের বেলা ভিক্ষা করে বেড়ালেও রাতে রাস্তায় শুতে ভয় পেত ছেলে দু’টো। তাই কাকার বাড়ির সিঁড়িতেই রোজ রাতে ঘুমোতে তারা।
হালাবির কথায়, ‘‘ওমর-মুফেদাহরা তো একটা উদাহরণ। সিরিয়ায় এখন রোজ রোজ শ’য়ে শ’য়ে শিশু অনাথ হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি, যুদ্ধের সমস্ত আতঙ্ক কাটিয়ে তাদের একটা সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দেওয়া।’’ হালাবির এই কর্মযজ্ঞ একার নয়। শিক্ষক থেকে মনোরোগী। ২৫ জনের একটা দল রয়েছে ওই অনাথ আশ্রমে। নাচ-গান নাটকের সঙ্গে সঙ্গে রোজ লেখাপড়াও শিখতে হয় যুদ্ধে সব হারানো শিশুদের। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার টাকায় মূলত চলে এই আশ্রম। আশ্রমের এক মনোবিদ বললেন, ‘‘আচমকা কোনও বিমান হানায় বাবা-মাকে হারালে শিশুদের মনে যে ভয়ঙ্কর চাপ তৈরি হয়, তা কাটাতে তাদের দীর্ঘ কাউন্সেলিংও করানো হয়। এতে কাজ হচ্ছে। বেশির ভাগ শিশুই ক’দিন তাঁদের সঙ্গে থাকার পরে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারছে। যে শিশুরা যুদ্ধ-বিমান বা সাইরেনের আওয়াজে ভয়ঙ্কর ভয় পেত, তারাই এখন মাটির তলার বাঙ্কার থেকে উঠে এসে বিমান দেখতে চাইছে।’’