মেয়েরা চাকরি করলেই খুন বা ধর্ষণ, ফের ত্রস্ত আফগানিস্তান

রাত গভীর হয়েছে। উত্তর আফগানিস্তানের কুন্দুজ শহরের পথঘাট তখন বেশ শুনসান। আচমকা নৈঃশব্দ খান খান করে মহল্লায় ঢুকল হানাদাররা। তালিবান— ঘুম ভাঙা চোখে ঘরে ঘরে ফিসফাস। তালিবানের দাপটে প্রশাসন আজকাল উধাও কুন্দুজ এবং আশপাশের এলাকা থেকে।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৫ ১১:৪৯
Share:

আফগানিস্তানে আশ্রয় শিবিরে পালিয়ে আসা মেয়েরা। ছবি: এএফপি।

রাত গভীর হয়েছে। উত্তর আফগানিস্তানের কুন্দুজ শহরের পথঘাট তখন বেশ শুনসান। আচমকা নৈঃশব্দ খান খান করে মহল্লায় ঢুকল হানাদাররা। তালিবান— ঘুম ভাঙা চোখে ঘরে ঘরে ফিসফাস।

Advertisement

তালিবানের দাপটে প্রশাসন আজকাল উধাও কুন্দুজ এবং আশপাশের এলাকা থেকে। রাত নামলেই বাড়তে থাকে কালাশনিকভের শাসানি। এমনই এক থমথমে রাতে এই হানাদারি। এক মহিলা রেডিও সঞ্চালকের বাড়ির সিড়ি পর্যন্ত গড়িয়ে এল হানদারদের বুটের আওয়াজ। মহিলা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, কী উদ্দেশ্যে এসেছে রাতের ‘অতিথি’রা। বিছানা ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, পা টিপে টিপে বাড়ির বেসমেন্টে গিয়ে লুকোলেন তিনি। এর মধ্যেই দরজায় টোকা পড়েছে। কপাট না খুলেই মহিলার কাকা জিজ্ঞাসা করেছেন, কী চাই? তালিবান কম্যান্ডারের শীতল কণ্ঠস্বর বলেছে, এই বাড়িতে একজন চাকুরিরতা মহিলা থাকেন বলে খবর রয়েছে তাদের কাছে। গৃহকর্তা অস্বীকার করলেন। দরজা খুলতে তাঁকে বাধ্য করল তালিবানরা। ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। কয়েক মুহূর্তের নৈঃশব্দ। তার পরই বিকট শব্দ করে আগুন উগরে দিল কালশনিকভের নল। রেডিও সঞ্চালকের কাকার নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়। দু’দিন ধরে ওই খানেই লুটিয়ে রইল শব। কার এত হিম্মত যে মৃতদেহ তুলে এনে সৎকারের ব্যবস্থা করবে!

কুন্দুজে এখন এটাই নিত্যনৈমিত্তিক ছবি। শুধু কুন্দুজ নয়, আফগান মুলুকের সব তালিবান মুক্তাঞ্চলেই এখন চাকুরিরতা মহিলাদের খোঁজে বাড়ি বাড়ি চলছে হানাদারি। তালিবানের কড়া ফতোয়া, স্বামীর সঙ্গে ছাড়া বাড়ির চৌকাঠের বাইরে পা রাখবে না মেয়েরা। চাকরি করা কিছুতেই চলবে না। নির্দেশ না মানলেই মৃত্যু। কোনও মহিলাই যাতে উপার্জন করতে না পারেন, তা সুনিশ্চিত করতে এতটাই তৎপর তালিবানরা যে সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় মায়েদের পাশে থাকেন যে আয়ারা, তাঁদের পেশার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে। ফতোয়া না মেনে যে মেয়েরা চাকরি করেন, তাঁদের হয় খুন হতে হচ্ছে, না হলে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বন্দি শিবিরে। সেখানে রোজ তালিবান ‘যোদ্ধা’রা ধর্ষণ করছে বন্দি মহিলাদের। দাবি এক মহিলা পরিচালিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের। মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত বেশ কয়েকটি রেডিও স্টেশন তালিবানরা তছনছ করেছে কুন্দুজে। যে সব অফিসে মহিলারা চাকরি করেন, সেখানে হানা দিয়ে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। কম্পিউটার তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লুঠতরাজ চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে মেয়েদের স্কুল। আর মহিলাদের সাহায্যার্থে গড়ে ওঠা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে সমূলে শেষ করা হয়েছে।

Advertisement

তালিবানের ভয়ে বা পরিজনদের হাতে ‘অনার’ কিলিং-এর আতঙ্কে অনেক মেয়ে এখন ঘরছাড়া আফগানিস্তানে। কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই পলাতক মেয়েদের আশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু কুন্দুজ বা কন্দহরে সেই আশ্রয় শিবির চালানো অসম্ভব। এই সব মুক্তাঞ্চলে যখন তখন হানা দেয় ঘাতক বাহিনী। আশ্রয় শিবির তছনছ করে, আশ্রিতাদের ধর্ষণ করে, খুন করে। তাই অসহায় মেয়েদের উদ্ধার করে এখন কাবুল বা তার কাছাকাছি কোথাও পাঠিয়ে দিচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি। তাতেও শান্তি নেই। নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মী হাসিনা সরওয়ারি জানালেন, উড়ো ফোনে কয়েক দিন আগেই কেউ জিজ্ঞাসা করেছে, আশ্রয় শিবিরের মেয়েরা কোথায়? প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও, হাসিনা সামলে নেন দ্রুত। কড়া গলায় জানিয়ে দেন, মেয়েরা কাবুলে নিরাপদে রয়েছে। এর দিন কয়েকের মধ্যেই হাসিনার বাড়িতে কাগজে মোড়া বিয়ের কার্ড পাঠিয়েছে তালিবানরা। চিঠিতে লিখেছে, তালিবান কম্যান্ডারের সঙ্গে হাসিনার বিয়ে দেওয়া হবে। এই হুমকি হালকা ভাবে নিতে পারছেন না তিনি। জানাচ্ছেন, এক সরকারি কর্তার স্ত্রীকে সম্প্রতি তুলে নিয়ে গিয়ে কম্যান্ডারের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে তালিবানরা। সুযোগ পেলেই হাসিনা সরওয়ারিরও একই হাল করবে তারা।

তবু থামছেন না হাসিনারা। আবার নিশ্চিতভাবে বলতেও পারছেন না, কত দিন চালানো যাবে এই লড়াই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন