‘আমার ভালু যাচ্ছে, ওকে নিয়ে খেলো সিরিয়ার বন্ধু’

আলেপ্পো কথাটা বলতে খানিক খটোমটো লাগে তার। তবে ‘সিরিয়া’ বলে একটা দেশ আছে, তা জানে একরত্তি মেঘ গঙ্গোপাধ্যায়!

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:৩৪
Share:

ভিন্‌দেশি বন্ধুর জন্য নিজের খেলনা ভালুকও ছাড়তে রাজি দমদমের খুদে মেঘ গঙ্গোপাধ্যায়।

আলেপ্পো কথাটা বলতে খানিক খটোমটো লাগে তার। তবে ‘সিরিয়া’ বলে একটা দেশ আছে, তা জানে একরত্তি মেঘ গঙ্গোপাধ্যায়!

Advertisement

এবং তার মতো ছোটরা সেখানে ভাল নেই এটুকু তার জানা। ভাল না-থাকা মানে কী?

সেটাও মা-বাবার কাছে শুনে তার নিজের মতো করে বুঝেছে দমদম এলাকার খুদেটি। চার বছরের মেঘ জানে, সিরিয়ার ছোটদের কারও কারও এখন নিশ্চিন্তে বাড়িতে থাকার জো নেই! তাদের মা-বাবারা তাদের আদর করতে পারছে না ঠিক মতো। এবং তাদের কাছে এখন খেলনাও নেই যথেষ্ট। তাই নিজের সব থেকে প্রিয় দু’টো খেলনার একটি, সেই না-দেখা দূরদেশের দুঃখী বন্ধুদের হাতে তুলে দিচ্ছে সে।

Advertisement

মেঘের মা-বাবা বলছিলেন, একটা তুলতুলে কুকুর আর শ্বেতভল্লুককে পাশে নিয়ে রোজ সে ঘুমোত। সিরিয়ার খুদেদের জন্য এদের মধ্যে ‘ভালু’কে সে দিয়ে দিতে রাজি হয়েছে এক কথায়।

বেঙ্গালুরুতে কর্মরত কলকাতার মেয়ে বিদিশা দাসও সিরিয়ার বাচ্চাদের জন্য চান্নাপটনা এলাকা থেকে কর্নাটকের সাবেক কাঠের খেলনা বোঝাই করেছেন। আলেপ্পোর খবরাখবরের জন্য সারা ক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় দুশ্চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে এই তরুণী। আরও কিছু সংবেদী

নাগরিকও ব্যস্ত এই খেলনা রফতানিতে। কেউ কেউ হস্তশিল্প মেলা ঘুরে সংগ্রহ করেছেন পিংলার কাঠের খেলনা।

কিন্তু যুদ্ধধ্বস্ত দুর্গম দেশে সেই খেলনা যাবেটা কী করে? এর জন্য সবার ভরসা এখন সিরিয়ার ‘টয় স্মাগলার’ বলে পরিচিত যুবক রামি আধাম। আদতে আলেপ্পোর ছেলে রামি দীর্ঘদিন ধরে ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিবাসী। গত পাঁচ বছরে ২৫ বার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিরিয়ায় পাড়ি দিয়েছেন তিনি। দুর্গতদের জন্য ত্রাণের সঙ্গে ছোটদের মন ভাল করতে অঢেল খেলনা নিয়ে গিয়েছেন রামি। এ দেশ থেকে যাঁরা খেলনা

পাঠাচ্ছেন, তাঁদের ভরসাও ‘খেলনা পাচারকারী’ রামি।

শ্বেতভল্লুক

কলকাতা ও বেঙ্গালুরুতে সংগ্রহ করা সব খেলনা নিয়ে ক’দিন বাদেই হেলসিঙ্কির উদ্দেশে রওনা দেবেন ফিনল্যান্ডের আলতো বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট ডিজাইনিংয়ের ছাত্র গৌতম বিশ্বনাথ। তিনিই রামির হাতে খেলনা তুলে দেবেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেই সবার মধ্যে যোগাযোগ হয়েছে।

শনিবার রামি হেলসিঙ্কি থেকে আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘যা-ই ঘটুক, জানুয়ারির গোড়াতেই খেলনা নিয়ে সিরিয়ায় যাচ্ছি। তুরস্ক হয়ে ঢুকব, আমি!’’ ওই যুবকের কথায়, ‘‘আমার এক মেয়েই প্রথম বলেছিল, ‘বাবা, খেলনা নিয়ে যাও!’ যুদ্ধ, বোমাবাজির মধ্যে ভয়ে, হতাশায় সামান্য একটা খেলনা হাতে পেলে বাচ্চারা যেন নতুন করে প্রাণ পায়।’’ তবে কোনও কোনও মহলে রামির কাজ নিয়ে বিতর্কও তৈরি হয়েছে। রামির তহবিল গড়া ও টাকা খরচ নিয়ে ফিনল্যান্ড সরকার তদন্ত করেছে। যদিও এখনও পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে গোলমেলে কাজের প্রমাণ মেলেনি।

তবে ছড়িয়ে পড়েছে মাইলের পর মাইল হেঁটে বাচ্চাদের রামির খেলনা বিলির ছবি। ঠিক যেমন ভূমধ্যসাগরপারে পড়ে থাকা সিরিয়ার মৃত শিশু আলান কুর্দি বা বিস্ফোরণে আহত, কালিঝুলিমাখা ওমরান দাকনিশের ছবি এখনও সবার চোখে লেগে। আলেপ্পোর সাম্প্রতিক সঙ্কটের পরে সাত বছরের বানা আল-আবেদের টুইট-ছবি নিয়েও নানা জল্পনা চলছে। ঠিক তেমনই অজস্র ছবিতে দেখা যাচ্ছে, রামির হাত থেকে পুতুল বা খেলনা জন্তু নিতে মুখিয়ে রয়েছে বাচ্চারা। সিরিয়ার রাজনীতি নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সিরিয়ার শিশুদের ছবি অনেকের মনেই গভীর ছাপ ফেলছে।

মেঘের বাবা যেমন বলছিলেন, ‘‘সিরিয়ার বাচ্চারা খেলনা পেয়ে কষ্ট ভুলে থাকবে, এটা ভেবেই শান্তি পাচ্ছি।’’ রামির মাধ্যমে সিরিয়ার শিশুদের জন্য এ দেশ থেকে অনেক খেলনাই এখন ফিনল্যান্ডে যাচ্ছে। আগামী বছরের গোড়াতেই যা সঙ্গে নিয়ে ফের সিরিয়ায় যেতে রামি তৈরি।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন