International News

‘দেশদ্রোহী’! প্রাক্তন ‘র’ প্রধানের সঙ্গে বই লিখে রোষে অবসরপ্রাপ্ত আইএসআই চিফ

তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে পাকিস্তানে। বইয়ের নাম— ‘দ্য স্পাই ক্রনিকলস: র, আইএসআই অ্যান্ড দ্য ইলিউশনস অব পিস’। লেখক— এ এস দুলত, আদিত্য সিংহ, আসাদ দুরানি। বইয়ের বিষয়বস্তু বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন এখন পিছনে। সামনে চলে এসেছে উত্তপ্ত বিতর্ক।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৮ ১৭:৩০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না দুরানি। এই রকম কোনও কাজ হওয়া সম্ভব? ‘র’ এবং ‘আইএসআই’-এর প্রধান একসঙ্গে বই লিখবেন! ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় টানাপড়েনের কারণ হয়ে উঠেছিল যে ঘটনাগুলো, সেগুলো নিয়েই লিখবেন! সেই বইয়ের বিষয়বস্তু পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যও হবে!

Advertisement

অপার বিস্ময় নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিক আদিত্য সিংহের সামনে এই রকম কয়েকটা প্রশ্নই রেখেছিলেন ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্সের (আইএসআই) অবসরপ্রাপ্ত প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসাদ দুরানি। বইটা শেষ পর্যন্ত লেখা হল, প্রকাশিতও হল। আর তার পরে আরও চমকে যেতে হল এক কালের প্রধান পাক গুপ্তচরকে।

তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে পাকিস্তানে। বইয়ের নাম— ‘দ্য স্পাই ক্রনিকলস: র, আইএসআই অ্যান্ড দ্য ইলিউশন অব পিস’। লেখক— এ এস দুলত, আদিত্য সিংহ, আসাদ দুরানি। বইয়ের বিষয়বস্তু বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন এখন পিছনে। সামনে চলে এসেছে উত্তপ্ত বিতর্ক। পাক সামরিক বাহিনীর জেনারেল পদমর্যাদার আধিকারিক চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে ভারতের প্রাক্তন প্রধান গুপ্তচরের সঙ্গে মিলে একগুচ্ছ বিতর্কিত বিষয় নিয়ে বই লিখলেন কোন সাহসে? পাক সামরিক বাহিনীর যে আচরণবিধি রয়েছে, তা অনেকাংশেই অবসরপ্রাপ্ত কর্মী বা কর্তাদের উপরেও প্রযোজ্য। পাক বাহিনী বলছে, আসাদ দুরানি সে সবের তোয়াক্কা না করে অত্যন্ত বিতর্কিত এবং স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে অকাতরে নিজের মতামত এবং অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে এনেছেন, প্রাক্তন ‘র’ চিফ-এর সঙ্গে নানা বিষয়ে সহমতও হয়েছেন।

Advertisement

পাক সামরিক বাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে তলব করা হয়েছে আসাদ দুরানিকে। পাক সেনার মুখপাত্র মেজর জেনারেল আসিফ গফুর জানিয়েছেন— স্পাই ক্রনিকলস নামের বইটিতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসাদ দুরানির মতামত হিসেবে যে সব কথা লেখা হয়েছে, সে সম্পর্কে তাঁর অবস্থান কী, আসাদ দুরানিকে তার ব্যাখ্যা দিতে বলা হবে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

স্পাই ক্রনিকলস লেখার পরিকল্পনা প্রথমে আদিত্য সিংহই করেছিলেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ‘র’-এর প্রধান পদে থাকা দুলত এবং ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত আইএসআই প্রধান পদে থাকা দুরানির কাছে প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন আদিত্য নিজেই। তখনই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন দুরানি। তবে শেষ পর্যন্ত রাজিও হয়েছিলেন।

ইস্তানবুল, ব্যাঙ্কক, কাঠমান্ডু— মূলত এই তিন শহরে দফায় দফায় মুখোমুখি হয়েছিলেন দুলত, আদিত্য ও দুরানি। কথোপকথনে উঠে এসেছিল নানা প্রসঙ্গ— কাশ্মীর, হাফিজ সইদ, ২৬/১১, কুলভূষণ যাদব, ওসামা বিন লাদেন, ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আমেরিকা-রাশিয়ার ভূমিকা, ভারত-পাক শান্তি প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসের প্রভাব।

প্রতিটি বিষয়ই অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সে সব বিষয়ের বেশ কয়েকটিতে দুলত এবং দুরানির ঐকমত্য আরও চাঞ্চল্যকর।

অ্যাবটাবাদে অভিযান চালিয়ে লাদেনকে যে ভাবে নিকেশ করেছিল মার্কিন নেভির সিল কম্যান্ডো বাহিনী, তা নিয়ে দুরানির মতামত বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আইএসআই সম্ভবত ওসামার বিষয়ে সব জানত এবং আমেরিকার সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতেই লাদেনকে মার্কিন বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল ইসলামাবাদ— পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধান গুপ্তচর এমনই লিখেছেন বইটিতে। তাঁর ভারতীয় প্রতিমূর্তি দুলত জানিয়েছেন, ‘র’-এর কাছেও সে রকমই খবর ছিল। কথোপকথনের ঢঙে এর পরে দুলত জানতে চেয়েছেন, ওসামাকে নিয়ে পাকিস্তান এবং আমেরিকার মধ্যে ঠিক কী রকম চুক্তি হয়েছিল? দুরানি সে বিষয়ে আর মন্তব্য করেননি। জানিয়েছেন, নিশ্চিত ভাবে কিছুই তাঁর জানা নেই, সবটাই তাঁর ধারণা।

আরও পড়ুন: শান্তি আলোচনা চান না মোদী, দাবি মুশারফের

কুলভূষণ যাদব প্রসঙ্গে যে আলোচনা দুরানি, আদিত্য এবং দুলতের মধ্যে হয়েছে, তাও বেশ চাঞ্চল্যকর। স্পাই ক্রনিকলসে বর্ণিত সে কথোপকথনের অংশবিশেষ তুলে ধরেছে পাক সংবাদপত্র ‘খালিজ টাইমস’। সেখানে দুরানি জানাচ্ছেন, ২০১৬-র ২ জানুয়ারি পঠানকোট বিমানঘাঁটিতে যে জঙ্গি হামলা হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। সেই অস্বস্তি কাটাতেই কুলভূষণ যাদবকে সামনে আনা জরুরি ছিল। দুলত প্রশ্ন করেছেন, কী ধরনের অস্বস্তিতে ভুগছিল পাকিস্তান? দুরানি জানিয়েছেন, পঠানকোটে হামলার সঙ্গে সরাসরি পাক সেনার যোগ খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিল ভারত। তাই পাকিস্তান আগেই প্রমাণ করতে চাইছিল যে, ভারতও একই কাণ্ড ঘটাচ্ছে পাকিস্তানে।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিষয়বস্তুর এই সব অংশে চোখ রাখলেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, পাক সেনায় কেন তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ওই বইতে দুরানির অনেক মন্তব্যই ভিত্তিহীন এবং বাস্তবের সম্পূর্ণ বিপরীত— দাবি করছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রবল প্রতাপশালী সামরিক বাহিনী।

শুধু সামরিক বাহিনী অবশ্য নয়, বইটি নিয়ে ঝাঁঝালো মতামত দিতে শুরু করেছেন পাক রাজনীতিকরাও। অপসৃত পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ অবিলম্বে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা সমিতির (ন্যাশনাল সিকিওরিটি কমিটি) বৈঠক ডাকার দাবি তুলেছেন বলে খবর। পাক সেনেটের চেয়ারম্যান রাজা রব্বানি-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা বইটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সামরিক বাহিনীর কেউ না হয়ে কোনও রাজনীতিক বা সাধারণ নাগরিক যদি এমন কোনও বই লিখতেন, তা হলে এতক্ষণে তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে দেওয়া হত বলেও রাজনৈতিক শিবির থেকে মন্তব্য আসতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন: সহকর্মীকে ‘হ্যান্ডসাম’ বলায় বরখাস্ত টিভি সঞ্চালিকা

গোটা পরিস্থিতিতে অত্যন্ত ‘মর্মাহত’ আসাদ দুরানি। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার নিজের লোকেরাই আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এনেছেন, তাতে আমি মর্মাহত।’’ পাকিস্তানের জন্য তিনি জীবন বাজি রেখে কাজ করে গিয়েছেন বলে দুরানি দাবি করেছেন। নাম না করে প্রভাবশালী সামরিক কর্তাদের বিঁধেছেন প্রাক্তন আইএসআই প্রধান। বলেছেন, ‘‘যাঁরা নিজেদের স্বার্থ ভুলে অন্যদের জন্য বাঁচেন, তাঁরা প্রাপ্য মর্যাদা পান না, আর যাঁরা নিজেদের লাভের জন্য সব রকমের খারাপ কাজ করেন, তাঁদেরকে রাজা-রাজড়ার মতো রাখা হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন