পঠানকোটে পাক জঙ্গিদের হামলা পারেনি। এ বারে পেশোয়ারে তালিবানি তাণ্ডব কি তা পারবে? এই প্রশ্নটাই ভাবাচ্ছে এখন দিল্লিকে। পঠানকোটে হামলার জেরে ভারত-পাক আলোচনার দিন-তারিখে কিছু অদল-বদল ঘটলেও গোটা প্রক্রিয়াটি ভেস্তে যায়নি। বরং দু’দেশের সরকারই পঠানকোট-কাণ্ডের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার রাস্তাকে সন্ত্রাস ও বাদবাকি বিষয়— এই দু’ভাগে ভাগ করে এগোতে চাইছে। পেশোয়ারে বাচা খান বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলায় দু’দেশের মধ্যে সেই আলোচনা প্রয়াস ধাক্কা খেতে পারে বলে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে সাউথ ব্লকে।
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে শুধু নয় সন্ত্রাসে ভুক্তভোগী দেশ হিসেবেও ভারত আজ তীব্র ভাষায় পেশোয়ারের ঘটনার নিন্দা করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে কংগ্রেস ও বিজেপি-সহ বিভিন্ন দল আজ একই সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। পাশে দাঁড়িয়েছে পাক সরকারের। কারণ, পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তথা সে দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে দুর্বল করতেই যে এই আক্রমণ, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ সাউথ ব্লক। নওয়াজ ক্ষমতায় আসার পর এই চেষ্টা প্রথম বার হল, এমনটাও নয়। শরিফের আমলে পেশোয়ারেরই সেনা-স্কুলে, করাচি বিমানবন্দরে জঙ্গি হামলা ঘটেছে। তবে এ বারের ঘটনায় ভারতের বাড়তি উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে মনে করেছেন কূটনীতিকরা।
পাকিস্তানে অস্থিরতা বাড়লে ও রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হলে ভারতেও তার আঁচ এসে পড়ে। এবং পেশোয়ারের ঘটনা ফের সেই আশঙ্কা বাড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে নওয়াজের শান্তি প্রক্রিয়াকে সেনা, আইএসআই এবং মোল্লাতন্ত্রের একটি অংশ খুব একটা ভাল চোখে দেখছেন না, এমন রিপোর্ট রয়েছে দিল্লির হাতে। প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনের সময় থেকেই নওয়াজ উদ্যোগী হয়ে দেশের সেনা নেতৃত্বের সঙ্গে ভারত-নীতি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা শুরু করেছিলেন। নয়াদিল্লির সঙ্গে সামগ্রিক আলোচনার পথ খোলা, পরবর্তী কালে পঠানকোট-কাণ্ডে তদন্তের জন্য বিশেষ দল তৈরি করা, নিজের জন্মদিনে মোদীকে লাহৌরে আমন্ত্রণ জানানোর মতো পদক্ষেপও করেছেন নওয়াজ। এবং এমনও নয় যে, এই সব তিনি দেশের সামরিক নেতৃত্ব তথা আইএসআই-কে না জানিয়ে বা তাদের সম্মতি না নিয়ে করেছেন। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিজেই পাক সেনাবাহিনীর প্রাক্তন কর্তা। কিন্তু এটাও ঘটনা যে, সেনা, আইএসআই এবং মোল্লাতন্ত্রের একটি অংশের মধ্যে এর বিরোধিতা ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে। এ ছাড়াও, গত বছর পেশোয়ারের সেনা-স্কুলে হামলার পর থেকে পাক নেতৃত্ব তালিবানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর নীতি নিয়ে চলছেন। এর বিরুদ্ধেও ক্ষোভের আঁচ বাড়ছে তালিবানি জঙ্গি ঘাঁটি-সহ বিভিন্ন এলাকায়। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন যথেষ্টই অস্থির পাকিস্তানে।
পাকিস্তান সন্ত্রাসের কারখানা হয়ে উঠেছে, সন্ত্রাস পাচার করছে— এমন অভিযোগ নিয়ে এর আগে বহু বারই সরব হয়েছে ভারত। বড়সড় কোনও জঙ্গি হামলা ঘটলেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই বক্তব্যেই সিলমোহর লাগিয়েছে দিল্লি। আমেরিকার ‘ভাল তালিবান ও খারাপ তালিবান’ তত্ত্বকেও সমালোচনা করতে ছাড়েনি। কিন্তু হালে নওয়াজের নেতৃত্ব, পাক সেনা এবং আইএসআই-এর সঙ্গে তাঁর সমীকরণ ঘিরে যা-ও বা একটা আশার রুপোলি রেখা দেখা দিচ্ছিল, পেশোয়ার হামলা তা মুছে দিতে পারে— এই আশঙ্কাটাই বড় হয়ে উঠছে কূটনীতিকদের কাছে। প্রশ্ন উঠছে, পঠানকোট যেটা পারেনি, পেশোয়ার মত ঘটনা দ্বিপাক্ষিক আলোচনার রাস্তাকে আবার বিশ বাঁও জলে ডুবিয়ে দেবে না তো? পাকিস্তানে এই ধরনের ঘটনা লাগাতার চলতে থাকলে সে দেশের নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। তাতে সীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতিও যথেষ্ট চাপের মুখে পড়বে। এমন পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে যখন দু’দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনার অবকাশটাই আর থাকবে না। শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে চাইছে যে অংশ, তারাই ফের শেষ হাসি হাসবে।