নিকোলাস মাদুরোকে সরাতেই গণভোট চাইছেন দেশের বিরোধীরা।
আরও একটি গণভোট? এ বার লাতিন আমেরিকায়?
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে গণভোটের পথে প্রথম ধাপটি পেরোল দেশের বিরোধী দলগুলি। সে দেশের নিয়ম হল, গণভোটের আয়োজন করতে হলে দেশের ভোটারদের অন্তত এক শতাংশের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। ‘ন্যাশনাল ইলেকটরাল কাউন্সিল’ জানিয়েছে, বিরোধীরা চার লক্ষ আট হাজার সই সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন।
উগো চাভেসের বেছে নেওয়া উত্তরসূরি মাদুরোকে সরাতে খেপে উঠেছেন বিরোধীরা। কেন? ১৯৯২ সালের বিল ক্লিন্টনের ভাষায় বললে, ‘ইট’স দি ইকনমি, স্টুপিড!’ কয়েক বছর আগেও যে দেশের অর্থনীতি লাতিন আমেরিকায় এক নম্বর ছিল, ভিনদেশি শ্রমিকরা যে দেশে পাড়ি জমাতেন উন্নততর জীবনযাত্রার খোঁজে, সেই ভেনেজুয়েলা এখন নেই-রাজ্য। সরকারি হিসেবেই মূল্যস্ফীতির হার ৭০০ শতাংশ। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে। হাসপাতালে রোগীরা রয়েছেন কার্যত বিনা চিকিৎসায়। চিড়িয়াখানায় অন্তত ৫০টি প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে অনাহারে। খাবার নেই, ওষুধ নেই, এমনকী নেই টয়লেট পেপার, ডায়াপার। গর্ভনিরোধকের অভাবে মহিলারা ভিড় করছেন বন্ধ্যত্বকরণ কেন্দ্রে। বিপুল লোডশেডিং, আরও বিপুল বেকারত্ব। হিংস্র অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত এক বছরে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ নাগরিক অন্তত কয়েক দিন রাতে অভুক্ত অবস্থায় ঘুমোতে গিয়েছেন।
যেমন মোনিকা সাভালেতা। ভোর তিনটে থেকে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯ বছরের মেয়েটি। সরকারি সুপারমার্কেটের সামনে অবশ্য তারও ঢের আগে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। ফলে, দোকান যখন খুলল, এবং মোনিকা যখন ঢোকার সুযোগ পেলেন, তখন তাঁর জন্য পড়েছিল গোটা দুয়েক টুথপেস্টের টিউব। কোনও খাবার নেই। আবার কবে পাওয়া যাবে, কেউ জানে না।
গোটা ভেনেজুয়েলা এখন হন্যে হয়ে খাবার খুঁজছে। সরকারি দোকান থেকে ‘ন্যায্য মূল্যে’ খাবার পাওয়া যায় সপ্তাহে এক দিন। তা-ও, অধিকাংশ দিনই যতটুকু খাবার দোকানে থাকে, তাতে বেশির ভাগ লোককেই বহু ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে শেষ অবধি খালি হাতে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। চোরা বাজারে খাবার আছে, তবে তার দাম আকাশছোঁয়া। এক লিটার দুধের সরকারি দাম যেখানে ৭০ বলিভার, চোরা বাজারে তা ৭০০০ বলিভার। এক কেজি আটার দাম ৩০০০ বলিভার। পেশাদার নর্তকী মোনিকার সারা মাসের রোজগার, ১২,০০০ বলিভার।
গত মাসের শেষে প্রতিবেশী কলম্বিয়া সীমান্ত খুলে দিয়েছিল ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের জন্য, যাতে তাঁরা প্রয়োজন মতো বাজার করতে পারেন। সুপারমার্কেটের তাক ভরা পণ্য দেখে অনেকেই নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন।
এমন ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হল কী ভাবে? ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি প্রায় পুরোটাই পেট্রোলিয়াম-নির্ভর। দুনিয়ার সব চেয়ে বেশি পেট্রোলিয়াম রয়েছে এ দেশেই। দেশের জাতীয় আয়ের অর্ধেকটা আসে পেট্রোলিয়াম রফতানি থেকে, আর দেশের মোট রফতানির ৯৫ শতাংশই পেট্রোলিয়াম। আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম যখন ব্যারেল-প্রতি ১০০ ডলারের বেশি ছিল, তখন ভেনেজুয়েলার আর্থিক সমৃদ্ধিও ছিল চোখ ধাঁধানো। তেলের দাম কমে ব্যারেল-প্রতি ৫০ ডলারের নীচে চলে যাওয়ায় যে ধাক্কা লেগেছে, ভেনেজুয়েলা তা সামলাতে পারেনি। বিদেশ থেকে আমদানি করার মতো ডলারও নেই হাতে। দেশে-বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে রয়েছে মাত্র এক হাজার দু’শো কোটি ডলার। এ বছরের প্রথম ছ’মাসে সুইৎজারল্যান্ডের কাছে প্রায় সাড়ে সাতশো কোটি ডলারের সোনা বন্ধক দিয়েছে ভেনেজুয়েলা।
অন্য একটি সঙ্কট তৈরি করে গিয়েছেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট উগো চাভেস। দেশ যখন রমরমিয়ে চলছিল, তখন তিনি সব নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিলেন উৎপাদনমূল্যের চেয়ে ঢের কমে। তখন বিপুল ভর্তুকি দিয়ে সরকারি সুপারমার্কেটে খাবার বিক্রি হতো। কিন্তু খোলা বাজারে ব্যবসা করলেই লোকসান হবে, ফলে দেশে খাবার উৎপাদন কার্যত বন্ধই করে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এখন আর খাবার আমদানি করার টাকা নেই, ফলে প্রবল অনটন চলছে।
‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’-এর অর্থনীতিবিদ মৈত্রীশ ঘটক বললেন, ‘‘সমাজতান্ত্রিক আদর্শ মেনে দারিদ্র দূরীকরণ বা অসাম্য কমানোর চেষ্টা করা খুবই ভাল। কিন্তু বাজারের নিয়মকে অস্বীকার করলে তার ফল সব সময়ই মারাত্মক হয়। চাহিদা-জোগানের নিয়ম না মেনে জোর করে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে রাখলে বিপর্যয় শুধু সময়ের অপেক্ষা।’’
তেলের দাম তো গোটা দুনিয়াতেই কমেছে। তা হলে অন্য কোনও পেট্রোলিয়াম-রফতানিকারক দেশ ভেনেজুয়েলার মতো বড় সমস্যায় পড়ল না কেন? ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার হিসেব বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভেনেজুয়েলার অনেক দেনা। যে ডলার দিয়ে খাবার আমদানি করা যেত, তা দিয়ে দেনা পরিশোধ চলছে। গত এক বছরে ভেনেজুয়েলার আমদানির পরিমাণ কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এই আমদানির মধ্যে রয়েছে খাবার আর ওষুধও।
পঁচিশ বছর আগে ভিন্ন গোলার্ধের অন্য একটা দেশ, ঠিক এতটা না হলেও, এই ধরনের একটা আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়েছিল। তার অর্থমন্ত্রী পরিস্থিতি সামাল না দিলে হয়তো সেই দেশটার অবস্থাও ভেনেজুয়েলার মতোই হতে পারত।
ভেনেজুয়েলারও এক জন মনমোহন সিংহ প্রয়োজন ছিল।