অ্যান্ড্রিয়াস লুবিৎজ।
কয়েকটা শব্দ। শুধুই ঘুরপাক খাচ্ছে জার্মানউইঙ্গসের স্টুয়ার্ডেস মারিয়া ডব্লিউয়ের মাথায়। “এক দিন এমন কিছু করে দেখাব, যাতে গোটা সিস্টেমটাই বদলে যাবে। দুনিয়া আমার নাম জানতে পারবে। মনেও রেখে দেবে আমায়।” এক সময় কথাগুলো বলেছিলেন তাঁরই প্রাক্তন প্রেমিক। ফ্লাইট ৪ইউ৯৫২৫-এর কো-পাইলট অ্যান্ড্রিয়াস লুবিৎজ।
একটি জার্মান দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মারিয়া এমনই সব বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছেন। তরুণী জানিয়েছেন, আল্পস বিমান দুর্ঘটনায় লুবিৎজের নাম জড়াতেই ওই কথাগুলো মাথায় আসে তাঁর। বলেন, “সে দিন ওই শব্দগুলোর সারমর্ম উদ্ধার করতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি।”
গত বছর ইউরোপগামী বিমানে দু’জনের আলাপ হয়েছিল। সম্পর্ক দানা বাঁধে ক্রমশ। মারিয়া জানান, আপাতদৃষ্টিতে বেশ মিষ্টি স্বভাবের ছেলে ছিলেন লুবিৎজ। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে আকাশপাতাল তফাত ছিল। তরুণী বলেন, “যখন কাজ নিয়ে দু’জনের কথা হতো, ও অসম্ভব ক্ষেপে যেত। সব সময় খুব চাপে থাকত। কাজের জগতটা মোটে পছন্দ ছিল না ওঁর। মাঝেমধ্যেই ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠত ‘আমরা নেমে যাচ্ছি...’।” মারিয়া এ-ও জানান, লুবিৎজের এই অদ্ভুত আচরণের জন্যই তাঁদের সম্পর্কটা পাঁচ মাসের বেশি টেকেনি। তাঁর কথায়, “খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এক দিন তো রেগে গিয়ে অনেক ক্ষণ আমাকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল ও।”
লুবিৎজ যে চাপে ছিলেন, সে কথা জানিয়েছেন তদন্তকারীরাও। ২৮ বছরের যুবকটির ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে তাঁরা জানতে পেরেছেন, লুবিৎজের ভয় ছিল, উড়ান সংস্থা যদি তাঁর মানসিক অসুস্থতার কথা জানতে পারে, তা হলে লাইসেন্স কেড়ে নেবে। চাকরি চলে যাবে তাঁর।
ডুসেলডর্ফ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে গত দু’মাস ধরে চিকিৎসা চলছিল লুবিৎজের। গত কালই তাঁর মোন্টাবাউয়ারের ফ্ল্যাটে হানা দিয়ে গোয়েন্দারা প্রেসক্রিপশনের ছেঁড়া টুকরো খুঁজে পান। যাতে লেখা ছিল, তিনি অসুস্থ। পাইলটের আসনে বসার মতো শারীরিক অবস্থা তাঁর নেই। পরে আরও বেশ কিছু সিক-নোট খুঁজে পান তদন্তকারী অফিসাররা। সবেতেই একই ফরমান “বিশ্রাম নিন, কাজ থেকে দূরে থাকুন।” তা দেখেই গোয়েন্দারা নিশ্চিত, লুবিৎজের আশঙ্কাটা খুব অমূলক ছিল না।
এ প্রসঙ্গে জার্মানউইঙ্গস কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, লুবিৎজের অসুস্থতা নিয়ে তাঁরা কিছুই জানতেন না। এক কর্তা বলেন, “ওঁরই উচিত ছিল সংস্থাকে জানানো।” তবে এ কথাও মেনে নিয়েছেন তিনি, যে লোকটা বরাবর পাইলট হতে চেয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে নিজে হাতে কেরিয়ার শেষ করে দেওয়া কঠিন ছিল। বলেন, “ও জানত, পাইলট আর হওয়া হবে না। তাই হয়তো এ ভাবে শেষ হয়ে গেল!” কিন্তু তা বলে এতগুলো প্রাণকে বেঘোরে হত্যা করে? এ প্রশ্নের জবাব জানা নেই জার্মানউইঙ্গসের কোনও কর্তারই।
ইতিমধ্যে লুবিৎজ সম্পর্কে আরও নানা গল্প শোনা যাচ্ছে। যে মহিলার সঙ্গে শেষমেশ তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তার সঙ্গে প্রায় সাত বছরের সম্পর্ক ছিল লুবিৎজের। কিন্তু মাঝে মধ্যেই সে সম্পর্ক ভাঙত, আবার জোড়া লাগত। এ ভাবেই শেষমেশ বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কিছু দিন আগে ফের সে সম্পর্কে ফাটল ধরে। লুবিৎজের ঘনিষ্ঠ মহলে শোনা গিয়েছে, এ বার হয়তো পাকাপাকি ভাবে সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল। প্রেমিকাকে মানাতে এক সঙ্গে দু’-দু’টি অডি গাড়ি কেনার কথা ভাবছিলেন লুবিৎজ। শেষে একটা অর্ডার দেন। তা থেকেই অনেকের ধারণা, সব চেষ্টা বিফলে যায় তাঁর। আর একটি সূত্রে খবর, লুবিৎজ নাকি সমকামী ছিলেন। প্রেমিকা তা জানতে পেরে যান। সেই কারণেই বিয়ে ভেঙে যায়।
তদন্তকারী অফিসারেরা জানিয়েছেন, এ সবের কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে, তা জানতে জার্মানউইঙ্গসের বিমানকর্মীদের সঙ্গে খুব শীঘ্র কথা বলে দেখবেন তাঁরা। জেরা করা হবে ওই শেষ প্রেমিকাকেও। এ দিকে, ফ্লাইট ৪ইউ৯৫২৫-এর মৃত যাত্রীদের পরিবারের আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, চাইলেই জার্মানউইঙ্গসের কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেন ক্ষতিগ্রস্তরা। তাঁদের কথায়, “দু’রকম কথা বলছে জার্মানউইঙ্গস। এক বরা ওরা বলছে, উড়ানের আগে লুবিৎজ ১০০ শতাংশ ফিট ছিলেন। আবার পরে জানাচ্ছে, কোনও ভাবে নিরাপত্তা বলয়ের ফাঁক গলে বেরিয়ে গিয়েছেন উনি।”
তবে তথ্যপ্রমাণের কচকচি নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই মৃত যাত্রীদের পরিবারের। তাঁদের প্রশ্ন, “একটা নামী বিমান সংস্থা কী ভাবে এমন অপেশাদারিত্ব দেখাল? তাঁরা ঘুণাক্ষরেও টের পেল না! একটা মানসিক রোগীর হাতে প্লেনের দায়িত্ব দিয়ে অতগুলো প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলল কেন?” এ প্রশ্নের জবাব জানা নেই কারও কাছে।