বিরাম নেই তল্লাশিতে। ছবি: রয়টার্স।
এ বার নজর আন্দামানে।
মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের নিখোঁজ এমএইচ ৩৭০ বিমানের তল্লাশিতে যোগ দিচ্ছে ভারতও। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের এক মুখপাত্র বুধবার জানান, অনুসন্ধানে সাহায্য করতে চেয়ে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজেই একটি চিঠি লিখেছিলেন মালয়েশিয়াকে। সেই মতো তৈরি করা হয়েছে একটি বিশেষজ্ঞ দল। বুধবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে উপকূলরক্ষী বাহিনীর একটি বিমান তিন বার পাক খেয়েছে আন্দামান সাগরের চার পাশে। এখনও পর্যন্ত তেমন কিছুই নজরে পড়েনি তাদের। তবে তল্লাশি চলবে।
ভারত নিজেই সাহায্য করতে চেয়ে চিঠি লিখেছিল ঠিকই। তবে সেটা না হলেও সম্ভবত এ বার মালয়েশিয়ার অনুরোধেই ভারতকে মাঠে নামতে হতো। কারণ, তল্লাশির মানচিত্রে আন্দামান সাগরের নামটা এ দিন অন্য ভাবেও ঢুকে পড়েছে। মালয়েশিয়ার সামরিক রেডার-এ শনিবার রাত ২টো ১৫ নাগাদ একটি বিমানের গতিবিধি ধরা পড়েছিল। সেটি তখন ছিল মালাক্কা প্রণালীর উত্তর ভাগে পেনাং থেকে প্রায় ২০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। তাইল্যান্ডের সমুদ্রশহর ফুকেট-এর দক্ষিণে।
এই বিমানটিই কি এমএইচ ৩৭০? সেটা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এখনও। কিন্তু পাঁচ দিন ধরে হাওয়া হাতড়ানোই সার হয়েছে। বিমানের হদিস মেলেনি। কী হয়েছে, কোথায় হয়েছে সবই যেখানে অজানা, সেখানে ঠিক কোথায় খোঁজ করা উচিত, সেটাও জানা থাকে না। অজস্র পরস্পর-বিরোধী সূত্র সামনে আসতে থাকে। যেমনটি হচ্ছে, এমএইচ ৩৭০-এর ক্ষেত্রে। চিন এ নিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভও প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাদের হাতেও সব রকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। ফলে এই নতুন রেডার-সঙ্কেত ধরেই আপাতত এগোনো হচ্ছে। আর সেই সূত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ভারতীয় জলরাশি। কারণ, ফুকেট থেকে একটু এগোলেই আন্দামান সাগর।
এমনিতে এমএইচ ৩৭০ অসামরিক রেডারে শেষ বার ধরা দিয়েছিল শনিবার রাত দেড়টা নাগাদ। মালয়েশীয় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল-এর শেষ বার্তা চালাচালি হয়ও ওই রকম সময়েই। রেডিও-বার্তায় ‘অল রাইট’ জানান পাইলট। বিমান তখন মালয়েশিয়া ছেড়ে ভিয়েতনামের আকাশে ঢোকার মুখে। মালয়েশিয়ার এটিসি এমএইচ ৩৭০-কে জানায়, এ বার ভিয়েতনাম এটিসি কাজ শুরু করবে। তার কয়েক মুহূর্ত পরেই বিমান উধাও।
আজ এক দল ‘প্রত্যক্ষদর্শী’র দাবি, শনিবার রাত দেড়টার বেশ কিছু ক্ষণ পরে উত্তর-পূর্ব মালয়েশিয়ায় তাইল্যান্ড-সীমান্তে তাঁরা নাকি এমএইচ ৩৭০-কে দেখেছিলেন। দেশের উত্তর-পূর্বের শহর-গ্রামগুলোয় গিয়ে জনে জনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাতেই ন’জনের বক্তব্য সামনে আসে। দক্ষিণ চিন সাগরের উপকূলবর্তী শহর পেনারিকের বাসিন্দা এক বাসচালক জানান, তিনি ১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ একটি বিমানকে খুব নিচু দিয়ে যেতে দেখেছিলেন। মারাং গ্রামের বাসিন্দারা আবার পুলিশকে বলেছেন, শনিবার রাতে একটা বিকট আওয়াজ শুনেছিলেন তাঁরা।
এ সব কথা সত্যি কি না, জানার উপায় নেই। উত্তর-পূর্বের তাইল্যান্ড উপসাগরে বিমানটির খোঁজও মেলেনি। আর একটি তত্ত্ব বলেছিল, উত্তর-পূর্বে নির্ধারিত গতিপথে না গিয়ে বিমানটি মুখ ঘুরিয়ে মালয়েশিয়ার দিকে ফিরতে চাইছিল। মাঝপথে মালাক্কা প্রণালীতে সেটি ভেঙে পড়ে থাকতে পারে। মালাক্কা প্রণালীর কথা সামরিক রেডারেও ধরা পড়েছে। কিন্তু রেডার-সঙ্কেত অনুযায়ী বিমানটি আরও বেশ খানিকটা উত্তর-পশ্চিমে এগিয়েছিল। অথচ পাইলটরাই বলছেন, যে জায়গা থেকে বিমানটি রেডারের আওতার বাইরে চলে যায়, সেখান থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়।
তা হলে? দুর্ঘটনা ঘটে থাকলেও বিমানের ‘ব্ল্যাক-বক্স’ থেকে সঙ্কেত তো মিলত! তা কেন পাওয়া যাচ্ছে না? অভিজ্ঞ পাইলটদের কথায়, দুর্ঘটনার পরমূহূর্ত থেকেই প্রতি এক থেকে দেড় সেকেন্ড অন্তর ব্ল্যাক-বক্স থেকে একটি সঙ্কেত বেরোয়। একে ইমারজেন্সি লোকেটর ট্রান্সমিটার (ইএলটি) বলে। সমুদ্রের গভীরেই থাকুক কিংবা বিস্ফোরণেই পড়ুক, ৩০ দিন পর্যন্ত একটানা সেই সঙ্কেত পাঠিয়ে যায় ব্ল্যাক-বক্স। ব্ল্যাক-বক্সের ব্যাটারি যদি দুর্বলও থাকে, তা হলেও অন্তত এক সপ্তাহ সক্রিয় থাকা উচিত তার। আকাশপথে এই মুহূর্তে নজর রাখছে অজস্র বিমান। সমুদ্রে থিকথিক করছে জাহাজ। চিন ও মালয়েশিয়া সরকার সমস্ত উপগ্রহচিত্র ঘেঁটে ফেলেছে। তার পরেও সঙ্কেত না পাওয়ার অর্থ কী?
পাইলটদের বক্তব্য, যদি বিমান-অপহরণও হয়, তা হলেও তা রেডারে ধরা পড়ার কথা। পাইলটের মাথায় কেউ বন্দুক ঠেকিয়ে রাখলেও রেডারের সঙ্কেত আটকানো যায় নাা! আর এক পাইলটের বক্তব্য, “আসনের কুশন থেকে শুরু করে বিমানের ভিতরে এমন অনেক কিছু আছে, যা জলে ডোবে না। সে যত বড় দুর্ঘটনাই ঘটুক।”
কোনও সূত্রই তো মিলছে না! তবে কি এ কোনও নতুন ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে’র গল্প? অলৌকিক বিমান নিরুদ্দেশ? বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না? এক পাইলটের কথায়, “তাহলে তো ভাবতে হয়, কোনও অদৃশ্য শক্তির কবলে পড়ে উবে গিয়েছে বিমান! কিন্তু সেটা তো আর বিশ্বাসযোগ্য নয়!”
স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ যাত্রীদের পরিজনেরা। এ দিন মালয়েশীয় আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকে কেউ কেউ উত্তেজিত হয়ে জলের বোতল ছুড়ে মারেন। চিৎকার করে বলেন, “সত্যি কথাটা এ বার বলুন। অত বড় জিনিস তো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না? ছাই হয়ে গেলেও তো কিছু মিলবে!”
ছাইয়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা কঠিন সবাই জানে! ছাইয়ের গাদাটা খুঁজে পাওয়া তার চেয়েও কঠিন হয়ে উঠছে।