বছর চোদ্দোর উসেইদ বারহো। সমবয়সি আর পাঁচটা কিশোরের মতোই ফুটবল ভালবাসত সে। পছন্দের নায়ক জ্যাকি চ্যান, আর গায়িকা মানেই লেবাননের পপ-সুন্দরী ন্যান্সি আজ়রম। স্কুল শেষ করে কলেজে যাওয়ার স্বপ্ন দেখত ছোট্ট উসেইদ। জীবনের লক্ষ্য ছিল চিকিৎসক হওয়া। সবই চলছিল ঠিকঠাক। হঠাৎই যেন বদলে গেল ছবিটা। সিরিয়ার ছোট্ট সেই শহরের দখল নিল ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইএস)। মোড় ঘোরে উসেইদের জীবনেও।
দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর সম্প্রতি তাকে পাওয়া যায় ইরাকের রাজধানী বাগদাদের এক মসজিদে। চোখ-মুখে উদভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট। গুটি গুটি পায়ে মসজিদের দরজায় এসে জ্যাকেটের চেন খুলতেই সবার চোখ কপালে। খুদের শরীরে সাঁটা বিস্ফোরক! আত্মঘাতী হামলার দায়িত্ব ছিল তার। কিন্তু কিশোর জ্যাকেট খুলেই আত্মসমর্পণ করে। মুখ খোলে কিছু দিন পরেই। জানায়, জোর করেই যুদ্ধে নামানো হয় তাকে। আত্মসমর্পণের পুরোটাই তাই পরিকল্পনামাফিক।
খুদের কথায়, আইএস শহরের দখল নেওয়ার পরই স্থানীয় সুন্নি মসজিদে যাতায়াত শুরু হয় তার। উসেইদের বক্তব্য, “আমাদের মাথায় ঢোকানো হয়েছিল, শিয়া মানেই শত্রু। আমাদের শেষ করে দেবে ওরা। ওদের বিরুদ্ধে জেহাদে তাই নামতেই হবে।”
তাই আইএসে নাম লেখাতে এক দিন স্কুল পালায় খুদে। কিছু দিনের মধ্যেই ইরাকে আনা হয় উসেইদকে। সেখানে একই সঙ্গে চলতে থাকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, আর জেহাদি শিক্ষা। রাইফেল চালানো থেকে, বহুতল ওড়ানোর কৌশল কিশোরের দাবি, সবই শেখানো হতো সেখানে। দু’বেলা ভরপেট খাবারও অবশ্য মিলত। তবু এক সময় ভুল ভাঙে উসেইদের। তার কথায়, “দিব্যি ছিলাম, তবু মন থেকে মানতে পারছিলাম না ওদের আচার-আচরণ। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ধর্মের নামে ওরা আমাদের মাথাটাই আসলে খারাপ করতে চাইছে।” জঙ্গিনেতাদের অদ্ভুত কিছু স্ববিরোধিতাও চোখ এড়ায় না তার। নিজেরা দিব্যি ধূমপান করে, কিন্তু অন্য কেউ করলেই শাস্তি দেয়। মরুভূমির অন্ধকারে অবাধ যৌনতার দৃশ্য দেখেও একটু একটু করে ঘৃণা জন্মাতে থাকে কিশোর মনে। দল ছেড়ে পালানোর ইচ্ছেটা তখন থেকেই মাথাচাড়া দেয় বলে জানায় উসেইদ। মুক্তি অবশ্য মেলে না সহজে।
প্রশিক্ষণ শেষ হলে ইরাকের যুদ্ধে যেতে বলা হয় তাকে। কেউ চাইলে অবশ্য মানববোমাও হতে পারে। উসেইদ বেছে নেয় বিকল্প পথ। মসুল শহরে পৌঁছে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে দায়িত্ব আসে। মানববোমা হয়ে ওড়াতে হবে মসজিদ। সেই মতোই জ্যাকেটের নীচে একাধিক বোমা দিয়ে মুড়ে ফেলা হয় শরীর। যথা সময়ে, যথা স্থানে জঙ্গিরাই তাকে পৌঁছে দিয়ে যায়।
তার পর মসজিদের দরজায় পা রেখেই সেই হাড়হিম করা কাণ্ড। রক্ষীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে খুদে। জানায়, “আমার শরীরে বোমা বাঁধা আছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি নিজেকে মারতে চাই না।”
কিন্তু তার পর? কিশোরের ভবিষ্যৎ এখনও অন্ধকারেই। পরিবারের কাছেই ফিরতে চাইছে উসেইদ। চোখে তার এখনও ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। ইরাকি প্রশাসন প্রাথমিক ভাবে সহমর্মিতা জানালেও, এখনই তাকে ছাড়তে নারাজ। সম্প্রতি দেশের এক চ্যানেলে ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমা-ও দেওয়া হয়েছে তাকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রশাসনিক কর্তা অবশ্য আশার আলোই দেখালেন। বললেন, “আদালতে পেশ করা হলেও, আমরা কিশোরের পাশেই দাঁড়াব। হাজার হোক, এতগুলো মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে উসেইদ।”