নিখোঁজ বিমানযাত্রীদের জন্য প্রার্থনা। কুয়ালা লামপুরের ইন্ডিপেনডেন্স স্কোয়ারে। সোমবার।
মনে করা হয়েছিল, হারিয়ে যাওয়া বিমানের একটি দরজা হয়তো বা দেখতে পাওয়া গিয়েছে। ভিয়েতনামের পক্ষ থেকে রবিবারই জানানো হয়েছিল সে কথা। সোমবার দিনের আলো ফুটতেই সেখানে হাজির হয়েছিল ভিয়েতনাম নৌবাহিনীর বিমান। কিন্তু ভাসমান বস্তুটিকে এ দিন আর দেখাই যায়নি।
দিন গড়ালে এক সময় ফের শোনা যায় তাইল্যান্ড উপসাগরে হলুদ রঙের কিছু একটা ভাসতে দেখেছে ভিয়েতনাম নৌবাহিনীর বিমান। কিন্তু এ বারও হতাশা। দূর থেকে যেটিকে হারিয়ে যাওয়া বিমানের ‘লাইফ র্যাফট’ বলে মনে হয়েছিল, কাছে গিয়ে বোঝা যায়, সেটি আসলে শেওলা (মস) ঢাকা একটি তারের গোলা।
এ অবস্থায় ভরসা ছিল শুধু ভাসমান তেল। শনিবারই তাইল্যান্ড উপসাগরের একটি বিশাল অংশে জ্বালানি তেল ভাসতে দেখেছিলেন উদ্ধারকারী বিমানের কর্মীরা। সেই নমুনা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েঠিল। এ দিন জানা গিয়েছে, সেটি কোনও বিমানের জ্বালানি নয়।
সংবাদসংস্থা জানাচ্ছে, মালয়েশিয়ার বিমান দফতরের প্রধান আজহারউদ্দিন আব্দুল রহমান স্বীকারই করে নিয়েছেন, “দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমরা এখনও পর্যন্ত বিমানের কোনও অংশ খুঁজে পাইনি।” আমেরিকার গোয়েন্দা স্যাটেলাইটও কোনও হদিস দিতে পারেনি। ঠিক হয়েছে, এ বার আন্দামান সাগরেও বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর বিমানটির খোঁজ চালানো হবে। ক্ষুব্ধ চিন তার প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে মালয়েশিয়ায়। তদন্তের গতিপ্রকৃতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও ১০টি স্যাটেলাইটও তল্লাশিতে লাগাচ্ছে তারা।
কিন্তু সব মিলিয়ে তল্লাশি অভিযানে নতুন কোনও সূত্রই মেলেনি আজ। শুধু ভুয়ো পাসপোর্ট তদন্তের কাজ খানিকটা এগিয়েছে। ইতালি এবং অস্ট্রিয়ার পাসপোর্ট নিয়ে যে দু’জন বিমানে চেপেছিলেন, তাঁদের এক জনের পরিচয় জানতে পেরেছে মালয়েশীয় সরকার। তাঁরা এটুকু জানিয়েছেন, সেই ব্যক্তি এশীয়। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমেদ জাহিদ হামিদি ঝটিতি প্রশ্ন তুলেছেন, ইউরোপীয় পাসপোর্ট নিয়ে কোনও এশীয় বিমানে ওঠে কী করে?
এ সব প্রশ্ন অবশ্য এখনও অবধি ধাঁধার জট কোনও ভাবে খোলেনি। আরও জানা গিয়েছে, এমএইচ ৩৭০ উড়ানটিতে সে রাতে পাঁচ যাত্রী বিমানে না ওঠায় তাঁদের মালপত্র নামিয়ে আনতে হয়। তাঁরা কারা, কেনই বা বিমানে উঠলেন না এ প্রশ্নের জবাবও মেলেনি। ফলে সার্বিক ভাবে নাশকতা সংক্রান্ত আশঙ্কা আর অনুমান যে তিমিরে ছিল, সেখানেই থেকে গিয়েছে।
এ সব ক্ষেত্রে কী ধরনের নাশকতা ঘটার সম্ভাবনা থাকে? অভিজ্ঞ পাইলটদের একাংশ মনে করছেন, বিমান ছিনতাই হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ তা হলে তিন দিনের মধ্যে জানা যেত বিমানটি কোথায় রয়েছে। তাঁদের ধারণা, মাঝআকাশেই বড় কোনও গোলযোগের সম্মুখীন হয়ে থাকবে বোয়িং ৭৭৭-২০০।
কী ধরনের গোলযোগ হতে পারে? পাইলটরা বলছেন, যদি একসঙ্গে দু’টো ইঞ্জিনও বিগড়োয়, তা হলেও নির্বিঘ্নে নেমে আসা এবং এটিসি-র (এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল) সঙ্গে যোগাযোগ করার রাস্তা থাকে। ফলে তেমন কিছু ঘটলেও বিমানটি হারাতো না বলেই ভাবা যেতে পারে। তাঁরা উদাহরণ দিচ্ছেন, ২০০৯-এর জানুয়ারিতে দু’টো ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়া অবস্থাতেই যাত্রীদের নিয়ে ইউএস এয়ারওয়েজের একটি বিমান নেমে এসেছিল হাডসন নদীতে।
পাইলটদের বক্তব্য, আধুনিক বিমানের দু’টি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলে পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে সিলিং ফ্যানের মতো দেখতে একটি পাখা। একে বলা হয় ‘র্যাম এয়ার টারবাইন’ (র্যাট)। মাটি থেকে ৩৫ হাজার ফুট উপরে যে গতিতে হাওয়া বয়, তাতে সেই র্যাট-পাখা পাঁই পাঁই করে ঘুরতে শুরু করে। সেখান থেকে তৈরি হয় বিদ্যুৎ। ফলে, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও ওই পাখা থেকে তৈরি হওয়া বিদ্যুতে আবার সব স্বাভাবিক ভাবে চালু হয়ে যায়। ফলে সহজেই যোগাযোগ করা যায় এটিসি-র সঙ্গে। পাইলট চাইলে স্যাটেলাইট ফোনও ব্যবহার করতে পারেন। তা ছাড়া ওই পাখার সাহায্যেই প্রায় দেড়শো মাইল পাখির মতো ভেসে যেতে পারে বিমানটি। ‘ম্যানুয়াল’ ব্রেকও কাজ করে। ফলে, সমুদ্রে বা মাটিতেও নামিয়ে আনা যায় তাকে।
বিমানের খোঁজে ভিয়েতনামের বায়ুসেনার এক হেলিকপ্টারের আকাশপথে তল্লাশি।
সুতরাং মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বিমানে ইঞ্জিন সংক্রান্ত গোলযোগের তত্ত্ব কার্যত খারিজই করছেন বিমানচালকদের বড় অংশ। তাঁদের ধারণা, মাঝআকাশে কোনও ভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে বিমানের শরীরটাই। হয় ডানা ভেঙে পড়েছে, নয় শরীরটাই টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। যদিও এয়ার ইন্ডিয়ার এক সিনিয়র পাইলট এ-ও মনে করাচ্ছেন, প্রতিটি বিমান ছাড়ার আগে তার কল-কব্জা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়। “ফলে আচমকা বিমানের শরীর ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে, তা প্রায় অসম্ভব।”
তা হলে? পাইলটদেরও সন্দেহের তির নাশকতার দিকেই। তাঁদের অনুমান, হয় ভিতরে বোমা ফাটানো হয়েছে। নয়, পাইলটদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। নয়, পাইলটদেরই কেউ নাশকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উদাহরণ দিয়ে এক পাইলট বলেন, গত বছর ২৯ নভেম্বর মোজাম্বিকের একটি বিমান আঙ্গোলা যাচ্ছিল। পাইলট নিজে শৌচাগারে গিয়েছিলেন। কো-পাইলট ছিলেন আত্মঘাতী বাহিনীর সদস্য। তিনি ককপিটের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে বিমান নিয়ে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়েন মাটিতে। মারা যান সকলেই। মনে আসতে পারে ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার কণিষ্ক বিমান বিস্ফোরণের কথাও।
কিন্তু তিন দিন পরেও কেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ধ্বংসাবশেষ? এক পাইলট মনে করালেন, ২০০৯-এর জুনে অতলান্তিকে ভেঙে পড়েছিল এয়ার ফ্রান্সের বিমান এয়ারবাস ৩৩০। তার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল ঘটনার চার দিন পরে। আর আড়াই বছর লেগে গিয়েছিল সেই বিমান দুর্ঘটনার কারণ বার করতে। জানা গিয়েছিল, মারাত্মক ঝঞ্ঝা-র মধ্যে পড়ে সেই বিমানের ককপিটের সমস্ত ব্যবস্থা বিগড়ে গিয়েছিল। বিমান কখন সমুদ্রে নেমে এসেছিল, বুঝতেই পারেননি দুই পাইলট।
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বিমান তো ঝঞ্ধায় পড়েনি। আকাশ পরিষ্কারই ছিল। পড়ে থাকল, নাশকতার অনুমান। আর বাকি থাকল আরও একটা দিন। চার দিনের মধ্যেও যদি কিনারা না হয়, তা হলে এয়ার ফ্রান্সের এয়ারবাস ৩৩০ রহস্যকে টপকে যাবে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৭৭-২০০।
ছবি: এএফপি।