সলিলসমাধি হতে তখন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। টাইটানিকে বসে মাকে চিঠি লিখছিলেন সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী এশথার হার্ট। স্বপ্নসফরের প্রথম পাঁচ দিন কেমন কাটল, আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি, ঠিক কবে নাগাদ নিউ ইয়র্ক পৌঁছবেন তাঁরা, এ সব কথাই লেখা ছিল তাতে। জাহাজ অবশ্য গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই ডুবে যায়। তবে অক্ষত রয়ে যায় এশথারের সেই চিঠি। সম্প্রতি সেটিই নিলামে রেকর্ড দামে বিক্রি হল। সংশ্লিষ্ট নিলাম সংস্থা জানিয়েছে, চিঠিটির দাম উঠেছিল ১ লক্ষ ১৯ হাজার পাউন্ড।
ওই সংস্থার দাবি, এমন চিঠি আগেও নিলামে বিক্রি করেছে তারা। কিন্তু এশথারের চিঠিটি যেমন উন্মাদনা তৈরি করেছে তা কার্যত নজিরবিহীন। সংস্থার মুখপাত্রের বয়ানে, “চিঠিটি নিয়ে অনেকের মধ্যেই ভীষণ উৎসাহ তৈরি হয়েছিল।” কারণ দু’টো। প্রথমত, চিঠিটি লেখা হয়েছিল টাইটানিক থেকে। দ্বিতীয়ত, চিঠির তারিখ ছিল ১৪ এপ্রিল। অর্থাৎ টাইটানিকের অতলান্তিকে তলিয়ে যাওয়ার দিনই মাকে চিঠি লিখতে বসেছিলেন এশথার। সময়টা সম্ভবত দুপুরের দিকে। লেখিকার সঙ্গে তখন ছিল তাঁর সাত বছরের মেয়ে ইভাও। সব মিলিয়ে গত শতকের অন্যতম জাহাজডুবির গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছিল চিঠিটি।
তথ্য বলছে, ১৯১২ সালের ওই জাহাজডুবিতে যাত্রী ও কর্মী মিলিয়ে প্রায় পনেরোশো মানুষের সমাধি হয়েছিল অতলান্তিকে। যাঁর মধ্যে ছিলেন এশথারের স্বামীও। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ইভা ও এশথার বেঁচে যান। আর কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই বেঁচে যায় ওই চিঠিটিও। আসলে স্বামীর কোটে সেটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন লেখিকা। পরে আবার কনকনে ঠান্ডা থেকে এশথারকে বাঁচাতে তাঁকেই কোটটি পরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর স্বামী বেঞ্জামিন। জাহাজডুবি থেকে কোনও মতে বেঁচে ফেরার পর এশথার সেটিকে কোট থেকেই খুঁজে পান। তার পর তা চলে আসে ইভার হেফাজতে। এ নিয়ে একটি বই-ও লিখেছিলেন ইভা। আর তাতেই জানিয়েছিলেন, ওই চিঠিটি কী ভাবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এশথারকে সেই ভয়াবহ রাতের কথা বার বার মনে করিয়ে দিত। অতলান্তিকের জলে সব খোয়ানোর রাত, স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার রাত।
চিঠিতে অবশ্য সে সব হতাশার কোনও হদিস নেই। বরং পূর্ব লন্ডনের বাসিন্দা মা চাডওয়েল হিথকে এশথার জানাচ্ছেন ঠিক কী ভাবে ‘সি-সিকনেস’-এ(সমুদ্র সফরে অনেকেরই এই অসুস্থতা তৈরি হয়), কাহিল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। “দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করে এখন বিশ্রাম নিচ্ছি। গত কাল পর্যন্ত শরীরটা ভীষণ খারাপ ছিল। কিছু খেতে পারিনি। আজ সমস্যাটা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছি।” লিখেছিলেন এশথার। তার পরের অনুচ্ছেদেই আবার সফরের অভিজ্ঞতা লিখছেন তিনি। জানাচ্ছেন, “নাবিকরা তো বলছেন, এখনও পর্যন্ত সফর একদম মসৃণ হয়েছে। ...কিন্তু যদি কিছু গণ্ডগোল হয়, তা হলে যে কী হবে ঈশ্বরই জানেন। তবে আবহাওয়া এখনও বেশ ভাল। শুধু প্রচণ্ড ঠান্ডা।”
তাঁর আশঙ্কা যে এ ভাবে ফলে যাবে, তা বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি এশথার। সেই একটা রাত কেড়ে নিয়েছিল বেঞ্জামিনকে। ন্যূনতম মালপত্র যা সঙ্গে নিয়ে টাইটানিকে চড়েছিল তাঁর পরিবার, সে সবও কেড়ে নিয়ে অতলান্তিক। সহায়-সম্বলহীন, কপর্দকহীন জীবনটুকু অবশ্য বেঁচেছিল এইচএমএস কার্পেথিয়ার সৌজন্যে। এ জাহাজই উদ্ধার করেছিল এশথার ও ইভাকে। তার পর কোটের পকেট হাতড়ে চিঠিটি খুঁজে পান স্বয়ং লেখিকা। অনেকটা ঠিক জেমস ক্যামেরন পরিচালিত ‘টাইটানিক’ ছবিটির সেই দৃশ্যের মতো রোজ যেখানে ক্যাল-এর কোটের পকেট হাতড়ে খুঁজে পাচ্ছেন সেই নীল হিরে যা চুরির অভিযোগে জ্যাককে বন্দি করা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেই কোটটিই কেটকে পড়িয়ে দিয়েছিল ক্যাল। ঘুরেফিরে হিরের মালিকের কাছেই ফিরে আসে হিরে।
ঠিক যে ভাবে চিঠিটি ফিরে এসেছিল এশথারের কাছে। স্বপ্নসফরের ভয়ঙ্কর সমাধির একমাত্র স্মারক হয়ে।