কারও বাঁচার আশা নেই, জানাল মালয়েশিয়া

ভারত সাগরেই বিমানসমাধি

নিখোঁজ হওয়ার ষোলো দিনের মাথায় এমএইচ ৩৭০-র পরিণতি জানতে পারল দুনিয়া। স্থানীয় সময় রাত দশটা বাজার দু’-তিন মিনিট আগে জরুরি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ঘোষণা করলেন, “গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভারত মহাসাগরের গভীরেই তলিয়ে গিয়েছে বিমানটি।” আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে অস্ট্রেলিয়ার পারথ শহরের পশ্চিম দিকে সাগরের জলে যাত্রা শেষ করেছে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

কুয়ালা লামপুর শেষ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০১৪ ০৩:২৩
Share:

সাংবাদিক বৈঠকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। সোমবার। ছবি: এএফপি।

নিখোঁজ হওয়ার ষোলো দিনের মাথায় এমএইচ ৩৭০-র পরিণতি জানতে পারল দুনিয়া। স্থানীয় সময় রাত দশটা বাজার দু’-তিন মিনিট আগে জরুরি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ঘোষণা করলেন, “গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভারত মহাসাগরের গভীরেই তলিয়ে গিয়েছে বিমানটি।” আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে অস্ট্রেলিয়ার পারথ শহরের পশ্চিম দিকে সাগরের জলে যাত্রা শেষ করেছে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর। কারও বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা যে আর নেই, তা-ও স্পষ্ট করেই বলে দেন নাজিব।

Advertisement

সাংবাদিক বৈঠকের সামান্য আগেই অবশ্য খবরটা জেনে গিয়েছিলেন নিখোঁজ যাত্রীর পরিজনরা। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে তাঁদের মোবাইলে এসএমএস বার্তা আসে: অত্যম্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এমএইচ ৩৭০ বিমানটি চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে বলেই আমরা ধরে নিচ্ছি। সন্দেহাতীত ভাবেই বলা যেতে পারে, আরোহীদের কেউই আর বেঁচে নেই। অল্প ক্ষণের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী সকলকে বিষয়টি জানাবেন। সব রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার করে আমাদের স্বীকার করতেই হচ্ছে, বিমানটি ভারত মহাসাগরের দক্ষিণে তলিয়ে গিয়েছে।

বিমানে ২২৭ জন যাত্রী এবং ১২ জন বিমানকর্মী ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে পাঁচ জন ভারতীয়। বাকিদের মধ্যে চিনের নাগরিকরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, ১৫২ জন। তাঁদের পরিবার-পরিজনেরা এত দিন নিয়ম করে বেজিংয়ের একটি হোটেলে হাজিরা দিচ্ছিলেন। সেখানেই তাঁদের জানানো হতো তদন্তের অগ্রগতির খবর। কখনও বাড়ত উৎকণ্ঠা, কখনও উঁকি মারত সামান্য আশা। আজ সেখানেই টেলিভিশনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক দেখলেন তাঁরা। হু হু করে কান্নার বাঁধ ভাঙল তার পরেই। বেশ কয়েক জন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁদের স্ট্রেচারে করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। তবে গত তিন-চার দিনে যে ধরনের তথ্য-সম্ভাবনা-অনুমানের কথা উঠে আসছিল তদন্তে, তা বিমানটির এমন কোনও পরিণতিই ইঙ্গিত করছিল। সে দিক থেকে এ দিনের ঘোষণা কোনও অপ্রত্যাশিত খবর শোনায়নি।

Advertisement

সবিস্তার...

শুধু তাই নয়, বিমানটি কেন ও কী ভাবে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে গিয়ে পড়েছিল, তার উত্তরও এ দিন মেলেনি। নাজিব রাজাক জানিয়েছেন, আগামী কাল আরও একটি সাংবাদিক বৈঠক করবেন। সেখানে উত্তর মেলে কি না, তারই অপেক্ষায় রয়েছে গোটা পৃথিবী। গত ক’দিনে অস্ট্রেলিয়া, চিন এবং ফ্রান্সের উপগ্রহচিত্রে যে ভাবে একাধিক বার সন্দেহজনক ভাসমান বস্তুর সন্ধান মিলেছে, তাতে মনেই হচ্ছিল ভারত মহাসাগরেই মিলবে বিমানের ধ্বংসাবশেষ। সেই অনুমানই মিলিয়ে দিল ব্রিটিশ উপগ্রহ তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা ‘ইম্যারস্যাট’ এবং আকাশপথে দুর্ঘটনার তদন্তকারী সংস্থা ‘এএআইবি’-র বিশ্লেষণ। এই দুই সংস্থার তথ্যের উপর নির্ভর করেই সাংবাদিক বৈঠক করেছেন নাজিব।

নাজিব জানান, বিমানের অন্তিম পরিণতির হদিস দিতে সম্পূর্ণ নতুন এক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তা থেকেই জানা গিয়েছে, দক্ষিণ করিডরের উপর ভারত মহাসাগর দিয়েই উড়েছিল বিমানটি। উত্তর ও দক্ষিণের যে দু’টি করিডরে এত দিন তল্লাশি চালিয়েছে ২৬টি দেশ, সে করিডর দু’টিরও হদিস দিয়েছিল ইম্যারস্যাট-ই। রবিবারই ওই সংস্থা তাদের বিশ্লেষণ-নথি এএআইবি-র হাতে তুলে দিয়েছিল। আরও এক বার পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার পরেই সোমবার তা প্রকাশ্যে আনা হল। এএআইবি-র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিমানটি কোথায় রয়েছে সেটা খুঁজতে তাঁরা স্যাটেলাইট ও রেডার থেকে পাওয়া ডাটা-র উপরেই নির্ভর করেছেন। তল্লাশি অভিযানে কোথায় কী সূত্র মিলছে, তার উপরে নয়।

এ দিন সকালেই তল্লাশি থেকেও একাধিক আঁচ অবশ্য মিলেছিল। কারণ মালয়েশিয়ার পরিবহণ মন্ত্রী হিশামুদ্দিন হুসেন জানিয়েছিলেন, গত কাল যে কাঠের তক্তা ভেসে থাকতে দেখা গিয়েছিল, সে রকম তক্তা ছিল নিখোঁজ বিমানেও। তা ছাড়া আজ সকালে ফের চিনের একটি বিমানের কর্মীরা জানিয়েছিলেন, ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ প্রান্তের উপর কয়েক কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে বেশ কিছু সন্দেহজনক বস্তু ভাসতে দেখেছেন তাঁরা। পরে একটি মার্কিন বিমান খুঁজে দেখতে গিয়ে সেগুলি পায়নি। এর পর এক অস্ট্রেলীয় বিমানের কর্মীরা জানান, একটি সবুজ অথবা ধূসর রঙের গোলাকৃতি এবং একটি কমলা রঙের আয়তাকার বস্তু ভাসতে দেখেছেন তাঁরা। চিনের বিমানকর্মীরা যেখানে দেখেছিলেন, এগুলি সেখান থেকে অবশ্য বেশ অনেকটা দূরে। সেখানে জাহাজও পাঠিয়েছে অস্ট্রেলীয় প্রশাসন। ওই জিনিসগুলি যদি নিখোঁজ বিমানের অংশ বলে প্রমাণিত হয়, তা হলে ওই এলাকায় ‘ফ্লাইট ডেটা লোকেটর’ নিয়ে যাওয়া হবে। ইতিমধ্যেই সে রকম একটি যন্ত্র পাঠিয়ে দিয়েছে আমেরিকা। কুড়ি হাজার ফুট গভীরতা থেকেও অত্যাধুনিক এই যন্ত্র বিমানের ব্ল্যাকবক্স থেকে বেরোতে থাকা ক্ষীণ সঙ্কেত ধরতে পারে। আরও চোদ্দো দিন ব্যাটারি সচল থাকার কথা ব্ল্যাক বক্সটির। অনুসন্ধান প্রক্রিয়া তার মধ্যেই শেষ করার চেষ্টা হবে।

৮ মার্চ রাতে কুয়ালা লামপুর থেকে বেজিং যাওয়ার জন্য উড়েছিল এমএইচ ৩৭০। রাত ১টা ৭ মিনিটে বিমানের অকার্স (এয়ারক্রাফ্ট কমিউনিকেশনস অ্যাড্রেসিং অ্যান্ড রিপোর্টিং সিস্টেম) শেষ বার বার্তা দেয়। ১টা ১৯ মিনিটে মালয়েশিয়ার আকাশ ছেড়ে ভিয়েতনামের আকাশে ঢোকার মুখে বাণিজ্যিক রেডারে শেষ রেডিও-বার্তা দেন কো-পাইলট, ‘অলরাইট গুড নাইট!’ এর পর রাত ২টো ১৫-য় সামরিক রেডারে এক বার ধরা পড়ে বিমানটি। তাতেই দেখা যায়, সে মুখ ঘুরিয়ে মালাক্কা প্রণালীর দিকে চলে যাচ্ছে।

শেষ রেডার সঙ্কেত মেলার পরেও বিমানটিতে আট ঘণ্টা ওড়ার মতো জ্বালানি থাকার কথা, বলা হচ্ছিল বারবারই। মালাক্কা প্রণালী থেকে ভারত মহাসাগরে উড়ে আসতে সাত ঘণ্টার মতো সময়ই লাগে। এটাও জানা গিয়েছে, ৩৫ হাজার ফুট থেকে আচমকা নেমে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছিল বিমানটি। ইনমারস্যাট-এর মুখপাত্র জানিয়েছেন “বিমানটি একই গতিতে উড়ছিল কি না, তাও জানি না। সুতরাং আমরা অটোপাইলটের গতি ধরে নিয়ে এগিয়েছি।” বিমানের ডাটা সিস্টেম থেকে উপগ্রহে যে ‘পিং মেসেজ’ যায়, তার নথি ও পরিধি এবং জ্বালানির সঞ্চয় হিসেব করেই তাঁরা বিশ্লেষণে নেমেছেন।

চারপাশে কোথাও মাটির চিহ্নমাত্র নেই। আর কিছুটা এগোলেই দক্ষিণ মেরু। এই ধু ধু জলরাশির মধ্যে কোন নিশি-ডাকে উড়ে এল এমএইচ ৩৭০?

গত ১৫ মার্চ শনিবার সাংবাদিক বৈঠক ডেকে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেছিলেন, ইচ্ছাকৃত ভাবেই রাস্তা বদল করেছিল এমএইচ ৩৭০। কারা, কেন এ কাজ করল, তা নিয়ে জল্পনা কম হয়নি। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনও সূত্র সামনে আসেনি আজও। বিমানটি ছিনতাই হয়েছে কি না, কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘাপটি মেরে রয়েছে কি না, এত দিন সে সব প্রশ্ন সকলের মনেই ঘুরছিল। আজকের পর বিমানের সলিলসমাধি নিয়ে আর কোনও সংশয় রইল না বটে। কিন্তু কারা, কেন এ ভাবে মৃত্যুমুখে ঝাঁপাল, সে প্রশ্ন দু’টো রয়েই গেল। লক্ষণীয় ভাবে নাজিব এ দিন তাঁর বিবৃতিতে এক বারও বিমানটি ‘ভেঙে পড়া’ বা ‘দুর্ঘটনা’র মুখে পড়ার মতো কোনও শব্দ উচ্চারণ করেননি। বরং তাঁর মুখে বারবার ফিরে আসছিল বিমানের অন্তিম পরিণতি, পরিসমাপ্তি বা ‘এন্ড’-এর কথা।

এমএইচ ৩৭০ নিয়ে অবশিষ্ট রহস্যের পরিসমাপ্তি কাল ঘটবে কি? আরও কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন