সাংবাদিক বৈঠক করছিলেন মালয়েশিয়ার পরিবহণ মন্ত্রী হিশামুদ্দিন হুসেন। হঠাৎই ছন্দপতন। খবর এল, ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে এক এলাকায় ভাসমান বস্তুর ছবি তুলেছে চিনের এক উপগ্রহ। এবং হতে পারে সেটি নিখোঁজ বিমান বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআরের ভাঙা অংশ। খবরটি তখনই মালয়েশিয়ায় চিনের রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন হিশামুদ্দিন। রাখঢাক না করে তাই সাংবাদিকদেরও তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলেন।
চিনের দাবি, ১৮ মার্চ অর্থাৎ চার দিন আগে উপগ্রহে ধরা পড়েছিল, ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে একটি বস্তু ভাসছে। সেটির দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে বাইশ মিটার। প্রস্থ ১৩ মিটার। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়াও দাবি করেছিল, তাদের বাণিজ্যিক উপগ্রহ এমনই ভাসমান দু’টি বস্তুর সন্ধান পেয়েছে। চিনের এ দিনের দাবির পর অনেকের ধারণা, হয়তো ওই বস্তুগুলির একটিরই খণ্ডাংশ ভাসতে দেখেছে চিনের উপগ্রহ।
এবং তা ভাবার পিছনে কয়েকটি যুক্তিও রয়েছে। প্রথমত, অস্ট্রেলিয়ার উপগ্রহ বস্তুদু’টিকে ভাসতে দেখেছিল পারথ থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। আর চিন জানিয়েছে, তারা বস্তুটিকে ভাসতে দেখেছিল ওই এলাকা থেকে আরও ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণে। সুতরাং হতেই পারে অস্ট্রেলীয় উপগ্রহচিত্রে ধরা পড়া ওই বস্তু দু’টির কোনও একটিই ভাসতে ভাসতে আরও দক্ষিণে চলে গিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ার উপগ্রহ ছবিটি তুলেছিল ১৬ মার্চ। আর চিনের উপগ্রহ ছবিটি ধরেছে তার ঠিক দু’দিন পরে। প্রবল জলস্রোতের টানে আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে সেটি যে ১২০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া যে খুবই সামান্য ব্যাপার, তা অনেকেই জানেন। তৃতীয়ত, অস্ট্রেলিয়ার উপগ্রহ যে দু’টি বস্তুর ছবি তুলেছিল, তাদের মধ্যে বড়টির আয়তন ছিল ২৪ মিটার। সেটিরই ভগ্নাংশের ছবি তুলেছে চিনের উপগ্রহ, বিশ্বাস অনেকের।
অনুমান, সম্ভাবনা, তত্ত্ব; চোদ্দো দিন পরেও তদন্তকারীদের সম্বল বলতে এ সবই। তল্লাশি বলতে যা চলছে সবটাই এক কথায় অন্ধকারে হাতড়ানো। এবং তাতেও লাভ কিছু হবে বলে আশা নেই। অস্ট্রেলিয়া যে দু’টি বস্তুর সন্ধান দিয়েছিল, দিন তিনেক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার সন্ধান মেলেনি। চিন যে জিনিসটির কথা বলছে, শনিবারের তল্লাশির পর সেটিরও সন্ধান মেলেনি।
এবং বিশেষজ্ঞদের কারও কারও ধারণা, তার খোঁজ পাওয়া বেশ দুষ্কর। কারণ, ভারত মহাসাগরের ওই অংশের জলস্রোত প্রবল। তীব্র গতিতে বায়ুপ্রবাহ হয় সেখানে। সব মিলিয়ে যদি বিমানের টুকরো আদৌ সেখানে ভেসেও থাকে, তা এত দিনে হয় ডুবে গিয়েছে বা ৪০০-৫০০ কিলোমিটার দূরে সরে গিয়েছে। দু’ ক্ষেত্রেই সেগুলি খোঁজ পাওয়া ভারী সমস্যার। গত কাল এবং আজ আবহাওয়া তূলনামূলক ভাবে ভাল থাকায় সেখানে সহজে তল্লাশি চালাতে পেরেছে ৬টি বিমান এবং দু’টি বাণিজ্যিক জাহাজ। কিন্তু আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস, আগামিকাল থেকে এক সপ্তাহের জন্য আবহাওয়া খারাপ হবে। সে ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কতটা চালানো যাবে, তা নিয়েই সন্দেহ রয়েছে।
অন্য দিকে দিন যত গড়াচ্ছে, তত বিমানের ‘ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার’-এর ব্যাটারির আয়ু কমছে। বিশেষজ্ঞরা হিসেব কষে বলছেন, আরও চোদ্দো-পনেরো দিন সময় রয়েছে। এর মধ্যে যদি ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডারের পাঠানো সঙ্কেতের হদিস না মেলে, তা হলে বিমানের সন্ধান পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। কিন্তু সন্ধানে বাদ সাধছে প্রতিকূল আবহাওয়া। সময়ের সঙ্গে তাই প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে উদ্ধারকারী দলের কর্মীদের।
এ দিনও ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ প্রান্তের একটি বিশাল এলাকা খুঁজে দেখা হয়। শনিবার রাতের দিকে তল্লাশি অভিযানে সাহায্য করতে চিনের আরও দু’টি বিমান সেখানে পৌঁছবে। অন্য দিকে, সমুদ্রের গভীরে খোঁজ চালানোর জন্য আমেরিকার কাছে সাহায্য চেয়েছে মালয়েশিয়া। মার্কিন প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে
ভাববে বলেও আশ্বাস দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার উপ প্রধানমন্ত্রী ওয়ারেন ট্রাসের কথায়, “যত দিন না মনে
হচ্ছে খোঁজ সম্পূর্ণ বৃথা, তত দিন তল্লাশি চলবেই। তবে বর্তমানে মনে হচ্ছে, সে দিন আসতে এখনও বহু সময় বাকি।”