ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে চিনের অংশ হিসেবে দেখিয়ে মানচিত্র ছাপা হচ্ছে সে দেশের চাংসা শহরে। ছবি: রয়টার্স।
সমন্বয়ের পাশাপাশি সংঘাত।
নয়াদিল্লিতে নতুন সরকারের জমানাতেও ভারত-চিন সম্পর্ক যে তার সেই পুরনো ঐতিহ্য থেকে সরছে না তা আজ স্পষ্ট হয়ে গেল। তাদের অরুণাচল নীতিতে অটলই থাকছে বেজিং। সম্প্রতি নিজেদের নতুন মানচিত্রে অরুণাচল প্রদেশকে ফের তাদের অংশ বলে দাবি করল চিন।
অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চিনের এই টানাপড়েন অবশ্য নতুন কিছু নয়। আগেও বারবার অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের দেশেরই অংশ হিসেবে দেখিয়েছে বেজিং। ওই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বিশেষ স্টেপলড ভিসার ব্যবস্থা নিয়েও এক কালে জলঘোলা হয়েছে বিস্তর। মোদীর শাসনকালের শুরুতেও সামনে চলে এল অরুণাচল নিয়ে চিনের নাছোড় মনোভাব।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অরুণাচলের বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক তৈরি জন্য এ বার এমন একটা সময় বেছে নেওয়া হল যা তাৎপর্যপূর্ণ। দিল্লিতে সরকার বদলের পর এই প্রথম ভারতীয় দূত হিসেবে বেজিংয়ে গিয়েছেন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি। পঞ্চশীল নীতির ষাট বছর উপলক্ষে তাঁর এই পাঁচ দিনের চিন সফর। ইতিহাস বলছে, যখনই দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা টেবিলে মুখোমুখি বসেছেন, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা অরুণাচলের মতো বিষয়গুলিকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার বার্তা দিয়েছে চিন। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনা সেনার প্রতীকী অনুপ্রবেশ বা স্টেপলড ভিসার মতো উস্কানিমূলক প্ররোচনা এসেছে বেজিংয়ের তরফ থেকে।
চিনের নয়া মানচিত্র নিয়ে এ দিন অবশ্য কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত। মানচিত্রে যা-ই আঁকা হোক না কেন, অরুণাচল ভারতের অংশ এবং তা-ই থাকবে স্পষ্ট জবাব বিদেশ মন্ত্রকের। এই ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরুদ্দিন বলেন, “ওরা যখনই এই দাবি তুলেছে, সব মঞ্চেই প্রতিবাদ জানিয়েছি আমরা। এখন তো উপরাষ্ট্রপতি চিনেই রয়েছেন। তিনি নিশ্চয় সে দেশের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন।” ঘটনাচক্রে এ দিনই পঞ্চশীল নীতি নিয়ে এক বৈঠকে মুখ খুলেছেন হামিদ আনসারি। তাতে নয়া
বিতর্কের উল্লেখ না থাকলেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। “দু’দেশের মধ্যে যতই পার্থক্য থাকুক, তা ঘুচিয়ে পঞ্চশীল নীতির উপর ভিত্তি করে ভারত-চিন দু’পক্ষকেই আরও কাছাকাছি আসতে হবে” শনিবার নিজের বক্তৃতায় এমনটাই বলেছেন আনসারি।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর অরুণাচল প্রদেশে গিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। সেটা ২০১৩-র ২৯ নভেম্বর। সেখানকার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে, অরুণাচল যে ভারতেই অঙ্গ তা বোঝাতে ইতিহাস-পুরাণের অনুষঙ্গ টেনে এনেছিলেন প্রণববাবু। ভারতের পুবে তাকাও নীতির ক্ষেত্রে অরুণাচল প্রদেশ যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে একটা সময় এ ভাবেই উদ্যোগী হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। আর এই বার উপরাষ্ট্রপতি চিনে থাকাকালীনই দানা বাঁধল নতুন অশান্তি। পরিস্থিতি সামাল দিতে আপাতত তাঁর ভূমিকার উপরই আস্থা রাখছে প্রশাসন।
অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে এই হইচইয়ের মধ্যেই জানা গিয়েছে, গত তিন মাসে অন্তত দু’বার নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছিল চিনা বায়ুসেনার হেলিকপ্টার। প্রথম ঘটনা ৩০ এপ্রিলের। আর দ্বিতীয়টি এ মাসেরই তেরো তারিখের। আকাশসীমা ভেঙে পূর্ব লাদাখে হামেশাই ঢুকে পড়ে চিনা সেনার কপ্টার। ভারতীয় সেনাবাহিনী সূত্রে খবর, চুমার এলাকায় টিন ভর্তি খাবার, সিগারেটের প্যাকেটের সঙ্গে ছোট কাগজে লেখা বার্তাও মাঝেমাঝেই ফেলে পালিয়ে যায় তারা।
তবে এই ধরনের ঘটনা সাউথ ব্লকের কাছে অপ্রত্যাশিত নয় একেবারেই। বরং এমন ঘটনা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা যে ক্ষীণ, দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তা বুঝে গিয়েছেন কূটনীতিকরা। এমনিতে বেজিংয়ের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন একাধিক বার সে দেশে গিয়েছেনও তিনি। নিজের রাজ্যে চিনা লগ্নিও টেনে এনেছিলেন মোদী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি অংশের বক্তব্য, গোধরা কাণ্ডের পর আমেরিকার সঙ্গে মোদীর সম্পর্ক তিক্ত হওয়ায়, গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়েছিল বেজিং।
আগামী মাসেই শুরু হচ্ছে ব্রাজিল-রাশিয়া-ভারত-চিন-দক্ষিণ আফ্রিকা এই সাত দেশের জোটের সম্মেলন ব্রিকস। ব্রাজিলের ওই সম্মেলনে ভারত-চিন প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের পার্শ্ববৈঠক হবে। কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ব্রিকস সম্মেলনে দেশের সীমান্ত নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা যদি প্রধানমন্ত্রী মোদীর একটা লক্ষ্য হয়, তা হলে দ্বিতীয়টা অবশ্যই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দেওয়া।
ভারত-চিন সম্পর্কে সহজ বাতাস যে বইবে না, দু’পক্ষই তা জানে ভাল করে। সেই রাজনৈতিক পরিপক্কতাও এত দিনে তৈরি হয়েছে এই সম্পর্কের রসায়নে।
তাই নিত্যনতুন টানাপড়েন সত্ত্বেও ভবিষ্যতে নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশাই রাখছে সাউথ ব্লক।