মা-বাবার স্বপ্ন অপূর্ণ রাখতে চাননি ওঁরা

নয় নয় করেও বেশ কয়েক লক্ষ টাকার ধাক্কা। কেউ হয়তো সারা জীবন তিল তিল করে সঞ্চয় করে গিয়েছেন। কেউ বা বিক্রি করে দিয়েছেন ধানজমি। স্বপ্ন একটাই। হজযাত্রা। ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবার অন্তত এক বার হজ করে আসার স্বপ্ন দেখে সারা জীবন ধরে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২০
Share:

হজভূমিতে পদপিষ্ট হয়ে আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর আসার পর। শুক্রবার আমদাবাদে রয়টার্সের ছবি।

নয় নয় করেও বেশ কয়েক লক্ষ টাকার ধাক্কা। কেউ হয়তো সারা জীবন তিল তিল করে সঞ্চয় করে গিয়েছেন। কেউ বা বিক্রি করে দিয়েছেন ধানজমি।

Advertisement

স্বপ্ন একটাই। হজযাত্রা।

ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবার অন্তত এক বার হজ করে আসার স্বপ্ন দেখে সারা জীবন ধরে। হজে যাওয়া মানে সারা জীবনের পাপ স্খালন হওয়া। বৃদ্ধ বাবা-মাকে যে করে হোক এক বার তাই হজ করিয়ে আনার সংকল্প রাখেন সন্তানেরাও। সেই হজ যখন দুর্ঘটনার খবর এনে দেয়, চোখের জল যেন বাঁধ মানতে চায় না।

Advertisement

ঝাড়খণ্ডের সাহিল আনসারির মনের অবস্থা এখন ঠিক সেই রকমই। গোড্ডার বেলডিহি গ্রামের বাসিন্দা সাহিল। বৃহস্পতিবার দুপুরে টিভির খবর শুনেই মনটা ‘কু’ ডেকেছিল, মা-বাবার কিছু হয়নি তো?

সাহিলরা পাঁচ ভাইবোন। বাবা মহম্মদ রুস্তম (৬২) স্কুলে পড়াতেন। সাহিলের কথায়, ‘‘এত বড় সংসার! কতই বা রোজগার ছিল বাবার! তবু হজে যাওয়ার জন্য চাকরিজীবন থেকেই টাকা জমাতেন।’’ রুস্তম ২০১৩ সালে অবসর নেন। সাহিল বলেন, ‘‘বাবা বলেই রেখেছিলেন, অবসর নিয়ে প্রথম কাজ হল হজযাত্রা।’’ শরীর খারাপ থাকায় ২০১৪ সালে যেতে পারেননি। এ বারে স্ত্রী শাকিলাকে নিয়ে স্বপ্নপূরণে করতে বেরিয়েছিলেন।

বৃহস্পতিবার থেকেই বারবার মক্কায় বাবার মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছিলেন সাহিল। ও প্রান্তে ফোন শুধু বেজেই যাচ্ছিল। সাহিল মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, বয়স্ক মা-বাবা ভিড়ের মধ্যে হয়তো রিং শুনতে পাচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। সন্ধেবেলা ফোন ধরে ও-প্রান্তে মা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘‘বেটা তেরা আব্বাজি গুজর গ্যয়ে। উসে বচা নাহি সকা।’’

সাহিলের থেকেও অভাবী সংসার মোতাহারের। দিনমজুর পরিবারটিতে পাঁচ ভাই, এক বোন। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডি থানার চাকধাপাড়া এলাকার বাসিন্দা মোতাহার বাবা-মা হামিজুদ্দিন আর রহিছাকে হজে পাঠিয়েছেন। বড় ভাই ইজাহার পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন। বাকি মোতাহার, মোজাহার, আতিবুর এবং মেহেদি— চার ছেলে এক বাড়িতে বাবা ও মায়ের সঙ্গে থাকেন। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মোতাহারদের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, বাবা-মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে ছেলেরাই জোর করে দেড় বিঘা ধানজমি বিক্রি করে ৬ লক্ষ টাকা জোগাড় করেছিলেন। জমি বিক্রিতে প্রথমে সায় ছিল না হামিজুদ্দিনের। কিন্তু পাঁচ ছেলে একমত হয়েই বাবা-মায়ের হজ যাওয়ার খরচ তুলতে ওই জমি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২৬ অগস্ট কুশমন্ডির বাড়ি থেকে রওনা হন রহিছারা। তার আগে বাড়িতে ভিড় করে এসেছিলেন আত্মীয়-প্রতিবেশীরা। মাছের ঝোল

ভাত খেয়েছেন সবাই একসঙ্গে। তারপরে বড় রাস্তা পর্যন্ত সবাই মিলেই এগিয়ে দিয়ে এসেছেন হামিজুদ্দিনদের।

এখন খবর এসেছে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে রহিছা হাসপাতালে ভর্তি। আর হামিজুদ্দিনের খোঁজ নেই। গ্রামের লোকেরা ভরসা দিয়ে বলছেন, হামিজুদ্দিনের ফোন হারিয়ে গিয়েও থাকতে পারে। মোতাহারের কথায়, ‘‘কত কষ্ট করে ওঁদের পাঠিয়েছিলাম! এই আশাটুকুই আমাদের সান্ত্বনা। বাবা-মা সুস্থ হয়ে একসঙ্গে ফিরে আসুন।’’ তাঁদের এক আত্মীয় বলেন, ‘‘ওঁরা যে দিন ফিরবেন, ও ভাবেই সকলে মিলে গিয়ে বড় রাস্তা থেকে তাঁদের বাড়ি নিয়ে আসব।’’

নলহাটির রফিকুল ইসলাম মর্মে মর্মে বুঝছেন সাহিল-মোতাহারদের যন্ত্রণাটা। ২০০৯ সালে তিনিও বাবা-মাকে একই রকম কষ্ট করে হজে পাঠিয়েছিলেন যে! ১৯৯৯-এ রফিকুলের আব্বা মহম্মদ আবুল খায়ের স্কুলশিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। স্পষ্ট মনে আছে, তখন থেকেই সন্তানদের বলতেন, ‘‘বেঁচে থাকতে থাকতে একবার হজে যেতেই হবে!’’ সেই ইচ্ছা পূর্ণ হল তাঁরই এক অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মী বন্ধু আব্দুল রেকিবের হাত ধরে। আব্দুল সাহেব থাকেন নলহাটির সিউড়া গ্রামে। অবসরের পর থেকে তিনি নিয়মিত এসে আবুল খায়েরকে হজে যেতে উৎসাহ দিতেন। শেষ অবধি ২০০৯-এ দুই দম্পতির হজে যাওয়া স্থির হয়। খরচ হয়েছিল মথাপিছু প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। অবসরের সঞ্চয় থেকেই ওঁরা সেই টাকা তুলেছিলেন। রফিকুলের মনে আছে, ‘‘সেই প্রথম আব্বার হাতে মোবাইল ফোন দিয়েছিলাম। পইপই করে বলেছিলাম, জেড্ডায় নেমে ওখানকার সিম কিনে ফোনে লাগাতে।’’ পাক্কা চুয়াল্লিশ দিন পরে যখন ওঁরা ফিরলেন, সে দিন বুক থেকে বোঝা নেমে গিয়েছিল।

সেই রকমই একটা দিনের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তো সাহিলও। কিন্তু ফোনে মায়ের কাছ থেকেই শুনতে হল, অন্য হজযাত্রীদের সঙ্গেই জমরাত ব্রিজের দিকে পাথর ছুড়তে যাচ্ছিলেন তাঁরা। এতটাই ভিড় ছিল যে দু’জনে ভাল করে হাত ধরে রাখতে পারছিলেন না। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে আসা একটা জনস্রোতে রুস্তমের থেকে আলাদা হয়ে যান শাকিলা। তাঁর চোখের সামনেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এলাকাটা মৃত্যুভূমিতে পরিণত হয়। শাকিলা দূরে ছিটকে গিয়েছিলেন বলে বেঁচেছেন। রুস্তম বাঁচেননি।

মাকে আনতে এখন সাহিলের ছোট ভাই মক্কা যাচ্ছেন। সাকিলের এক আত্মীয় গুলাম সরবর বলেন, ‘‘একটাই শুধু সান্ত্বনা, রুস্তমের মৃত্যু হল মক্কার মতো পবিত্র স্থানে। ওই খানেই কবরের মাটি পাবেন তিনি।’’

(তথ্য: আর্যভট্ট খান, অনুপরতন মোহান্ত, রফিকুল ইসলাম)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement