মাজার-ই-শরিফে ভোট দিচ্ছেন আফগান মহিলারা। শনিবার। ছবি: এএফপি
বোরখার আড়ালে ঢাকা শ’য়ে শ’য়ে মুখ। তালিবান হুমকি হেলায় উড়িয়ে কাবুলের ভোট কেন্দ্রের বাইরে ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে। প্রশ্ন করতেই এক মহিলার স্পষ্ট জবাব, “ওই ভয়ে থাকলে কোনও দিন দেশ এগোবে না।”
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইয়ে দেশজুড়ে আজ এ ছবিই ধরা পড়ল। ঝড়-জল-বৃষ্টি, কনকনে ঠান্ডা এবং মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে দীর্ঘ লাইন পড়ল ৬০০০ কেন্দ্রে। ভোট পড়ল ৫০ শতাংশেরও বেশি। তালিবান বলেছিল, ভোট দেওয়া একটা বিদেশি আদব-কায়দা। যারা ভোট দেবেন, তাঁদের, ভোটকর্মী এবং নিরাপত্তারক্ষীদের নিকেশ করবে তারা। কিন্তু যতটা গর্জে ছিল তালিবান, আজ ততটা গুলি বর্ষাতে পারেনি। সারা দিনে এক মাত্র লোগার প্রদেশের একটি বুথ থেকেই বিস্ফোরণের খবর আসে। নিহত হয়েছেন এক জন। জখম দুই। যদিও তাতে কোনও মাথা ব্যথা নেই অধিকাংশেরই। নিজেদের সহকর্মীকে হারিয়েও দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি কেউ। ভোটকর্মীরা বরং বলেছেন, “এ ধরনের জঙ্গি হানা আমাদের লাগাম পরাতে পারবে না।” একই মেজাজ ভোটের লাইনেও। বছর আটচল্লিশে লায়লা নেয়েজির কথায়, “এক দিন তো মরতেই হবে। মরতে হলে মরব, তালিবানকে ভয় পাই না। আমার ভোটটা ওদের গালে একটা চড়।”
ছবিটা আরও স্পষ্ট হল নির্বাচন কমিশনের প্রধান আহমেদ ইউসুফ নুরিস্তানির কথায়। বললেন, “যা ভেবেছিলাম তার থেকেও বেশি সাড়া ফেলে দিয়েছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বেশ কিছু বুথে ব্যালট পেপার ফুরিয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় দফতর থেকে বাড়তি কাগজ পাঠাতে হয়েছে সেখানে।” শুধু তা-ই নয়। নিয়ম মতো বিকেল ৫টাতেই ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বহু কেন্দ্রে তখনও লম্বা লাইন। শেষমেশ সাধারণ মানুষের দাবি মেনে ভোট নিতে রাজি হন আধিকারিকরা। এমনটা যে হবে, একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় কিন্তু আগেই ধরা পড়েছিল। তারা জানিয়েছিল, ৭৫ শতাংশ আফগানই ভোট দিতে আগ্রহী।
তবু ভোট দেওয়ার জন্য মানুষের মধ্যে যে এতটা উৎকণ্ঠা জমে ছিল, তা হয়তো ভাবতে পারেননি কেউই। গত কয়েকটা মাস নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন একের পর এক জঙ্গি হানা ঘটিয়েছে তালিবান। শুক্রবারই এক পুলিশকর্মীর গুলিতে নিহত হয়েছেন এপি-র চিত্রসাংবাদিক আঙ্গা নাইদ্রিঙ্গহোউস। আহত হন ওই সংবাদ সংস্থারই সাংবাদিক। যদিও তাতে জঙ্গি যোগসাজশ ছিল কি না, এখনও জানা যায়নি। কিন্তু তার আগেও তো সন্ত্রাসের একটা দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। বুধবার অভ্যন্তরীণ মন্ত্রকের অফিসের বাইরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটে। নিহত হন ৬ পুলিশ অফিসার। তার এক দিন আগেই তালিবানের হাতে খুন হন এক প্রার্থী এবং তাঁর ৯ সমর্থক। গত মাসে আফগানিস্তানের নামজাদা সাংবাদিক সর্দার আহমেদকে হত্যা করা হয়। আরও কত কী...।
একাংশের মতে, মৃত্যুভয়ের থেকেও মানুষ তালিবান জমানা ফিরে আসার আতঙ্কে কাঁপছে আফগানিস্তান। ২০০১ সালে তালিবান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গত ১৩ বছর ধরে দেশ শাসন করেছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তরের পাশাপাশি এ বছরই আফগানিস্তান ছাড়ছে মার্কিন সেনা। অনেকেরই ধারণা, ন্যাটো চলে গেলেই ফের জাঁকিয়ে বসবে তালিবান। শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েরা যেটুকু এগিয়ে ছিল, হয়তো ততটাই পিছোতে হবে তাঁদের। আর এই সব কিছ ভবিষ্যতে একা হাতেই রুখতে হবে নয়া নির্বাচিত সরকারকে। তাই হয়তো প্রথম গণতন্ত্র হস্তান্তরকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে দেশবাসী। জোর গলায় গণতন্ত্রকে স্বাগত জানাচ্ছেন। আর সেই কারণেই হয়তো মেয়েরা এতটা সরব।
কারজাই আজ বলেন, “সাধারণ মানুষের কাছে আর্জি, খারাপ আবহাওয়া, শত্রু সব কিছু ভুলে ভোট দিন... আর দেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান।” নেহাতই ছাপোষা চেহারার রাবিয়া মেরজি ভোট দিতে গিয়েছিলেন জারগোনা হাই স্কুলে। শরীরে বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট। বয়সের ভারের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতাও অনেক। কারজাই-র প্রতিধ্বনি শোনা গেল বৃদ্ধার গলাতেও, “তালিবান হুমকি কাউকে থামাতে পারবে না।” বলেই, আঙুলের কালিটা দেখালেন ভোট দিয়েছেন। তাঁর কথায়, “আমরা যদি ওই হুমকিতে ভয় পাই, এ দেশের কোনও উন্নতি হবে না।” নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে ইসলামাবাদও। তবে শান্তি ফেরাতে ভোটকেই এক মাত্র রাস্তা মনে করছে না তারা। পাকিস্তানের মতে, আলোচনা ছাড়া গত্যন্তর নেই।