স্মৃতিভ্রম আর প্রেমকাহিনিতে বন্দি মহিলা ‘সিরিয়াল কিলার’

গল্প থেকে সত্যি আলাদা করতে পারেন না তিনি। এক যুগ ধরে জেলের অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকার পরেও ঠিক করে বলতে পারেন না, তিনি আদৌ ২৭ জন নিরপরাধ পুরুষকে খুন করেছেন কি না! কখনও হাসেন, কখনও আবার মুখ ফিরিয়ে নেন। প্রেমিকের কথা বলতে গিয়ে কখনও রেগে বলেন, সে শুধু মহিলাদেরই নয় বরং বাচ্চাদেরও যৌন হেনস্থা করে, কখনও আবার অকপটে স্বীকার করেন, এত সুন্দর কোনও মানুষ তাঁর জীবনে আর আসেনি আফগানিস্তানের সব চেয়ে নৃশংস খুনির তকমা নিয়ে এক যুগ ধরে জালালাবাদের জেলে আছেন শিরিন গুল। তাঁর মাথায় ‘সিরিয়াল কিলারে’র তকমা।

Advertisement

সংবাদ সংস্থা

জালালাবাদ (আফগানিস্তান) শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৫ ০২:৩৭
Share:

শিরিন গুল।

গল্প থেকে সত্যি আলাদা করতে পারেন না তিনি। এক যুগ ধরে জেলের অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকার পরেও ঠিক করে বলতে পারেন না, তিনি আদৌ ২৭ জন নিরপরাধ পুরুষকে খুন করেছেন কি না! কখনও হাসেন, কখনও আবার মুখ ফিরিয়ে নেন। প্রেমিকের কথা বলতে গিয়ে কখনও রেগে বলেন, সে শুধু মহিলাদেরই নয় বরং বাচ্চাদেরও যৌন হেনস্থা করে, কখনও আবার অকপটে স্বীকার করেন, এত সুন্দর কোনও মানুষ তাঁর জীবনে আর আসেনি!

Advertisement

আফগানিস্তানের সব চেয়ে নৃশংস খুনির তকমা নিয়ে এক যুগ ধরে জালালাবাদের জেলে আছেন শিরিন গুল। তাঁর মাথায় ‘সিরিয়াল কিলারে’র তকমা। অপরাধের প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন প্রেমিক রহমাতুল্লাহের কথা। বলেন, খুনের নেশা হয়ে গিয়েছিল ছেলেটার। তিনি বাধা দেননি! নিজেই বললেন, তাঁর স্বামীকেও তো খুন করেছে রহমাতুল্লাহ। সে বারেও তো তিনি বাধা দেননি! শিরিন অকপটে মেনে নেন, তিনি আগেই জানতেন তাঁর পরিবেশন করা চা আর কাবাব খেয়ে মারা যাবেন এক-এক করে ২৭ জন। ঘরের মধ্যে বসে বাগানে কোদালের কোপে মাটি কেটে কবর তৈরির শব্দ শুনতেন। জানতেন, তিনি মানুষ মারায় সাহায্য করছেন। মাঝে মাঝে পাল্টা প্রশ্ন করেন, তিনি নিজে খুন করেননি। নেশাগ্রস্ত মানুষটাকে ভয় পেয়েছিলেন মাত্র! ভয় পাওয়া কি অপরাধ?

২০০৪ সালে প্রথম অপরাধ কবুল করেন শিরিন। জানান, সহবাসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়িতে তিনি পুরুষদের ডেকে আনতেন। তার পর রহমাতুল্লাহ, তার ছেলে আর তাদের কয়েক জন সঙ্গী মিলে খাবারে বিষ মিশিয়ে খুন করতেন সক্কলকে। জানান, তাদের কাবুল আর জালালাবাদের বাড়ি দু’টোর বাগানেই পোঁতা আছে দেহগুলো। তার পর নিহত অতিথিদের গাড়ির নম্বরপ্লেট পাল্টে পাকিস্তানের সীমান্তের তালিবান অধ্যুষিত এলাকায় বিক্রি করা হতো। অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পরে শিরিন, রহমাতুল্লাহ, তার ছেলে সামিউল্লাহ-সহ ছ’জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আফগান আদালত। শিরিন ছাড়া বাকি পাঁচ জনকেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অপরাধ স্বীকার করার জন্য তাঁকে রেয়াত করেন আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। মৃত্যুদণ্ড থেকে শাস্তি কমিয়ে ২০ বছরের কারাবাসে এসে দাঁড়ায়।

Advertisement

জালালাবাদের নানগরহার জেলের মহিলা কারাগারের বেশির ভাগ বন্দি চুরি-ছিনতাই বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে অভিযুক্ত। খুনের অপরাধীও আছে। জেলের ওয়ার্ডেন কর্নেল আব্দুল ওয়ালি হাসারকের কথায়, “শিরিনের মতো আমি কাউকে দেখিনি।” যদিও শিরিন আর পাঁচ জনের মতোই থাকেন। কম্বল, বিছানা সবই ভাগাভাগি করে নেন সঙ্গীদের সঙ্গে। খানিকটা বাড়তি সম্মানও পান। ঠাহর করতে পারেন না, সেটা সম্মান নাকি ভয়ের নামান্তর। সাত বছর আগে জেলেই গর্ভবতী হয়েছিলেন তিনি। এখন তার সঙ্গেই অন্ধকারে পড়ে আছে তার সাত বছরের মেয়ে। মেয়েকে আদর করতে করতেই বলেন, “আমার চরিত্র খারাপ। তবে অনেক সময় আমি ভাল ব্যবহার করি।” রাখঢাক না করেই বলেন, তাঁর মাথার ব্যামো আছে। কোনটা ঘটেছে আর কোনটা ভাবছেন, সেটা অস্পষ্ট।

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য মেহনাজ সাদাতির কথায়, “উনি যেন সিনেমার চরিত্র।” সাদাতি মনে করেন, যে দেশ চার দশক ধরে যুদ্ধে দীর্ণ, যেখানে জীবন-মৃত্যু পাশাপাশি চলে, সেখানে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিরিনদের সঙ্গেও যে অন্যায় হয়, তার বিচার চাইবে কে? তিনি পাশে দাড়িয়েছেন শিরিনের। জানিয়েছেন, এই মামলার বেশিরভাগ নথিই উধাও হয়ে গিয়েছে। আর শিরিনের সম্পর্কে যতটা জানা গিয়েছে সবই জেলবন্দি হওয়ার পর বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন থেকে অনুমিত। এখন তাঁর স্মৃতি আর বিভ্রান্তি একাকার। কখনও তিনি খুনির পক্ষ নেন, কখনও আবার নিরপরাধ, অসহায় আর ভীত এক মহিলার বয়ানে কথা বলেন।

তবে এই ১২ বছরে তিনি এক বারও বলেননি তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপরাধের কথা। বলেননি তাঁর মেয়ের শৈশবহীন জীবনের কথা। তাঁর অধিকারের লড়াইয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন সাদাতি। তবে শিরিনরা যে এখনও স্মৃতিধাঁধায় বন্দি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন