Advertisement
Back to
Presents
Associate Partners
Lok Sabha Election 2024

ভোট-সন্ত্রাসের শিকার কিশোরকে মনে রেখেই ভোটের আগে ‘চুপ’ গ্রাম

দশ মাস পরে ফের ভোট। তা হলে আবারও কি সন্ত্রাস? ২০০৮ সালে পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রার্থী এমদাদুল কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “আগের সঙ্গে এখন অনেক পার্থক্য।”

কান্না: বোমার আঘাতে নিহত ইমরান হোসেনের শোকার্ত মা ও বাবা। দেগঙ্গার গাঙাটি গ্রামের বাড়িতে। 

কান্না: বোমার আঘাতে নিহত ইমরান হোসেনের শোকার্ত মা ও বাবা। দেগঙ্গার গাঙাটি গ্রামের বাড়িতে।  ছবি: সুদীপ ঘোষ।

শান্তনু ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৪ ০৭:৩৬
Share: Save:

দশ মাস আগের একটা রাত যেন বদলে দিয়েছে গোটা গ্রামকে। লোকসভা ভোটের আগে গ্রামে ইতিউতি পোস্টার পড়েছে, হয়েছে কিছু দেওয়াল লিখনও। তবু যেন ভোটের প্রচার থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়েই রয়েছেন গ্রামবাসীদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, “এক পক্ষ শান্ত থাকলে, অপর পক্ষ বাড়াবাড়ি করবে না। তাই চুপচাপ থাকাই ভাল। তা হলে তো আর কেউ ইমরান হবে না!”

দেগঙ্গা বিধানসভার সোহাই শেবপুর পঞ্চায়েতের গাঙাটি গ্রামের বাসিন্দা ইমরান হোসেন ব্যাট ধরলেই ছক্কা হাঁকাত। একাদশ শ্রেণির ওই পড়ুয়ার স্বপ্ন ছিল পুলিশে চাকরি করার। তাই রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে, গ্রামের মেঠো পথ ধরে দৌড়ত। সে সব অবশ্য আজ স্মৃতি! তার বাবা এমদাদুল হক আদ্যোপান্ত রাজনীতির মানুষ হলেও বছর সতেরোর ইমরান তেমনটা ছিল না। তবে মিটিং-মিছিল সেরে রাতে বাবার বাড়ি ফিরতে দেরি হলে তাঁকে ডাকতে রাজনীতির স্থলে পৌঁছে যেত সে। পঞ্চায়েত ভোটের দিন চারেক আগে, গত ৪ জুলাইও বাবাকে ডাকতেই গিয়েছিল ইমরান। তখনই ভোট-সন্ত্রাসের শিকার হতে হয়েছিল তাকে। বাড়ি ফেরার পথে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ওই কিশোরের বুক।

২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের 'দিল্লিবাড়ির লড়াই' -এর পাতায়।

চোখ রাখুন

দশ মাস পরে ফের ভোট। তা হলে আবারও কি সন্ত্রাস? ২০০৮ সালে পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রার্থী এমদাদুল কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, “আগের সঙ্গে এখন অনেক পার্থক্য। রাজনীতির উদ্দেশ্য তো সমাজের পরিবর্তন করা। কিন্তু তার থেকে খারাপ বেশি হচ্ছে। না হলে কি আমার ছেলেটা হারিয়ে যায়?’’ খানিক ক্ষণ চুপ থেকে পেশায় চাষি এমদাদুল প্রশ্ন তোলেন— “আমার ছেলেটা তো রাজনীতি করত না। তা হলে কেন বোমার আঘাতে মরতে হল?” পাশে বসা ইমরানের মা মমতাজ বেগম কোনও মতে চোখের জল সামলে বললেন, “ভোট হোক, কিন্তু আর কোনও মায়ের কোল যেন খালি না হয়।” ঘরের কোথাও ছেলের ছবি টাঙানো নেই। এমদাদুল বললেন, ‘‘সারা দিন ও কান্নাকাটি করে। আর ছেলে নেই, এটা আমরাও ভাবতে পারি না।’’ আর স্বামীর হাত থেকে মোবাইল
নিয়ে বুকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন মমতাজ।

কী হয়েছিল গত বছরের ৪ জুলাই? এমদাদুল জানান, পঞ্চায়েত ভোটের জন্য পাড়া বৈঠক করতে গিয়েছিলেন। রাত প্রায় ১১টা বাজলেও তিনি বাড়ি না ফেরায় রাতের খাবার খেয়ে বাবাকে ডাকতে গিয়েছিল ইমরান। কিছুটা দূরে যেতেই সে দেখতে পায়, এমদাদুল ও আরও কয়েক জন ফিরছেন। দাঁড়িয়ে যায় ওই কিশোর। ছেলেকে দেখতে পেয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতেই আচমকা ঢিলের মতো কিছু একটা এসে পড়ে রাস্তায়। পরক্ষণেই আরও একটা। বোমা ফাটার বিকট আওয়াজে সকলে ভয়ে ছুটতে শুরু করেন। কিন্তু
লুটিয়ে পড়ে ইমরান। তড়িঘড়ি তাকে বিশ্বনাথপুর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, সব শেষ। এমদাদুল বলেন, ‘‘আর ভাবতে চাই না। তবে ওই ঘটনার পরে ভোটের উদ্দীপনা অনেক কমে গিয়েছে। বুথে নববর্ষ পালন করিনি। হয়তো ছেলের স্মৃতি বুকে নিয়ে শেষে আমাকেও নামতে হবে।’’

এমদাদুলের আক্ষেপ, ছেলের খুনে অভিযুক্ত কয়েক জনকে প্রথমে পুলিশ গ্রেফতার করলেও কয়েক দিন পরে তাঁরা ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের কর্মাধ্যক্ষ মফিদুল হক সাহাজি বলেন, ‘‘প্রকৃত দোষীরা কড়া শাস্তি পেলে পরিবারটা শান্তি পেত, এটা ঠিক।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সিপিএম এক সময়ে অনেক অত্যাচার করলেও আমরা পরে প্রতিশোধ নিইনি। সেখানে বাম ও আইএসএফ মিলে এমন প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে, এটা আমরাও বুঝে উঠতে পারিনি।’’

তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ হোসেন। তিনি বললেন, ‘‘তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের তৈরি হাতিয়ারেই প্রাণ হারাতে হয়েছে ওই কিশোরকে। সেই তির আমাদের দিকে ঘুরিয়ে শাসকদল সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে।’’ তাঁর অভিযোগ, ঘটনার পরে সিপিএম কর্মীদের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। পুলিশকে দিয়ে মিথ্যা মামলা সাজানো হয়েছে। তাই অনেকেই এখনও ঘরছাড়া।

তবে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পথে হাঁটতে নারাজ গাঙাটির সাধারণ মানুষ। ইমরানের বাড়ির পাশেই মাটির বাড়ির বারান্দায় বসেছিলেন আব্বাস আলি। ছোট থেকে ইমরানের গৃহশিক্ষক ছিলেন তিনি। আব্বাস বললেন, ‘‘শান্তি বজায় রাখতে এক পক্ষকে ধীরে চলতে হলে, তা-ই করতে হবে।’’ স্নায়ুরোগে আক্রান্ত মমতাজ সকালে ঘুম থেকে উঠে জেনেছিলেন ছেলের মৃত্যুর খবর। রাস্তায় পড়ে থাকা বিড়াল-কুকুরছানাদের বাড়িতে নিয়ে আসত ইমরান। তাদের বুকে আঁকড়েই এখন আদরের ‘কচি’কে অনুভব করেন মা।

গাঙাটি গ্রামে ঢোকার রাস্তায় কিছুটা এগোলেই চোখে পড়ে সৌর আলোর বাতিস্তম্ভ। তপ্ত
দুপুরে সেখানেই পাইপ দিয়ে ছেলেকে স্নান করাচ্ছিলেন এক বাবা। থমকে যেতে হয়। দশ মাস আগে যে ওই বাতিস্তম্ভের নীচেই উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত ছেলেকে কোলে তুলে হাসপাতালে ছুটেছিলেন এমদাদুল!

২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের সমস্ত খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের 'দিল্লিবাড়ির লড়াই' -এর পাতায়।

চোখ রাখুন
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE